রাজধানীর ফার্মগেটে মেট্রোরেলের একটি পিলার থেকে ‘বিয়ারিং প্যাড’ খুলে নিচে পড়ে নিহত হয়েছেন আবুল কালাম (৩৫) নামে এক পথচারী। আজ রোববার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনার পর পুরো মেট্রোরেল লাইনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
এর আগে ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর একই এলাকায় মেট্রোরেলের আরেকটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল। তখন কোনো হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল প্রায় ১১ ঘণ্টা। ওই সময় গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল বলে দাবি করেছে ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
তবে এবারকার দুর্ঘটনায় পাঁচ সদস্যের নতুন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেন, ‘নতুন কমিটি আগের রিপোর্টও যাচাই করবে—ঘটনাটি নাশকতা, না নির্মাণত্রুটির কারণে ঘটেছে, সেটিও খতিয়ে দেখা হবে।’
‘বিয়ারিং প্যাড’ আসলে কী
মেট্রোরেল বা যেকোনো উড়ালসেতুর পিলার ও ভায়াডাক্টের সংযোগস্থলে বসানো হয় বিয়ারিং প্যাড, যা রাবার ও স্টিলের স্তরে তৈরি একধরনের স্থিতিস্থাপক অংশ। এর মূল কাজ হলো কাঠামোকে স্থিতিশীল রাখা এবং ট্রেন চলাচলের সময় কম্পন ও ঝাঁকুনি প্রতিরোধ করা।
প্রকৌশলীরা জানান, প্রতিটি প্যাডের ওজন ৫০ থেকে ২০০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং এটি নিওপ্রেন বা প্রাকৃতিক রাবার দিয়ে তৈরি। এগুলোর মান পরীক্ষার দায়িত্বে থাকে বুয়েট, যেখান থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পরই সেগুলো স্থাপন করা হয়।
কেন খুলে পড়ছে এই প্যাডগুলো
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিয়ারিং প্যাড সাধারণত কোনো নাট-বল্টু দিয়ে আটকানো থাকে না; বরং পিলার ও ভায়াডাক্টের নিজস্ব ওজনের চাপেই এটি স্থির থাকে। ফলে কোনো কারণে ভারসাম্য নষ্ট হলে বা স্থাপন ত্রুটি ঘটলে এটি নিচে পড়ে যেতে পারে।
বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, ‘এই ধরনের দুর্ঘটনা নকশাগত বা মান নিয়ন্ত্রণজনিত ত্রুটির ইঙ্গিত দেয়। মেট্রোরেলের মতো আধুনিক প্রকল্পে এমন ঘটনা ঘটানো একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘মেট্রোরেলে ট্রেন চলাচলের কারণে স্বাভাবিকভাবেই কম্পন সৃষ্টি হয়, যা যেকোনো প্রকৌশলীর জানা বিষয়। তাই বিয়ারিং প্যাড যেন স্থানচ্যুত না হয়, সে অনুযায়ী সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকা জরুরি ছিল।’
প্যাড নিয়ে বিতর্ক
ডিএমটিসিএলের কিছু কর্মকর্তা মনে করছেন, দুর্ঘটনাস্থল ফার্মগেট এলাকায় রেলপথে একটি বড় বাঁক রয়েছে এবং এটি তুলনামূলকভাবে উঁচু স্থানে অবস্থিত। ফলে কাঠামোর ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হতে পারে।
তবে অধ্যাপক সামছুল হক এই যুক্তিকে গ্রহণযোগ্য মনে করেন না। তার ভাষায়, ‘বাঁক বা উচ্চতা প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জ ঠিকই, কিন্তু তার জন্যই তো নকশা তৈরি করা হয়। এসব বিবেচনা করেই জাপানি পরামর্শকরা নকশা করেছেন। সুতরাং এখানে নিরাপত্তা ব্যর্থতা স্পষ্ট।’
ডিএমটিসিএল সূত্র জানিয়েছে, এবারের দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৩৩ নম্বর পিলারে, যা ফার্মগেট স্টেশনের পশ্চিম পাশে। গত বছর বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল ৪৩০ নম্বর পিলার থেকে।
মতিঝিল থেকে উত্তরা পর্যন্ত মেট্রোরেলে মোট ৬২০টি পিলার এবং ২ হাজার ৪৮০টি বিয়ারিং প্যাড রয়েছে। প্রতিটি পিলারে চারটি করে প্যাড বসানো আছে।
২০২০ সালেই যে প্রশ্ন তুলেছিল বুয়েট
বুয়েট ২০২০ সালে পরীক্ষার মাধ্যমে জানায়, উত্তরা-আগারগাঁও অংশে ব্যবহারের জন্য আনা কিছু বিয়ারিং প্যাড মানোত্তীর্ণ নয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইতাল-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি সরবরাহ করেছিল এসব প্যাড। মান যাচাইয়ে ব্যর্থ হওয়ায় পরবর্তীতে নতুন প্যাড আমদানি করতে হয়, ফলে প্রকল্পের কাজেও বিলম্ব ঘটে।
তবে অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পের শেষদিকে কিছু ত্রুটিপূর্ণ প্যাডই স্থাপন করা হয় এবং পরে সেগুলো আর পরিবর্তন করা হয়নি। এই সম্ভাবনাও এখন তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে।
সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ বলেন, ‘আগের ঘটনার পর সব পিলার বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে পরিদর্শন করা হয়েছিল। এখন আবার কেন খুলে পড়ল, সেটি তদন্ত করা হবে। নকশাগত ত্রুটির সম্ভাবনাও আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না।’
মেট্রোরেল বন্ধে দুর্ভোগ ও গুরুত্ব
দুর্ঘটনার পর দুপুরে মতিঝিল থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। আড়াই ঘণ্টা পর আংশিকভাবে আগারগাঁও থেকে উত্তরা পর্যন্ত চলাচল শুরু হয়।
বর্তমানে দিনে গড়ে সাড়ে চার লাখ যাত্রী মেট্রোরেলে যাতায়াত করেন। তাই সামান্য সময়ের জন্য মেট্রোরেল বন্ধ থাকলেও পুরো ঢাকার যানজটে ব্যাপক প্রভাব পড়ে।
প্রকল্প ব্যয় ও প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেল প্রকল্প অনুমোদন পায় ২০১২ সালে। প্রাথমিক ব্যয় ছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা, যা পরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকা দিয়েছে প্রায় ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকার ঋণ সহায়তা।
প্রতি কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ।

