বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভূমিধস, অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ এবং প্রকৃতির ভারসাম্যহীনতা সবকিছু মিলিয়ে স্থাপত্য ও বসবাসের ধরনে আসছে নাটকীয় পরিবর্তন।
এই বাস্তবতায় স্থাপত্যশিল্পে টেকসই নকশার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলাদেশি স্থপতি ও আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারজয়ী মেরিনা তাবাসসুম।
তিনি বলেছেন, ‘স্থাপত্য কেবল ভবন নির্মাণ নয়, এটি সংস্কৃতি, সমাজ ও মানুষের জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত এক জীবন্ত শিল্প। একজন শিল্পী একটি দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেন, আর তাঁর শিল্পকর্ম তাঁকে সারা জীবন বাঁচিয়ে রাখে।’
শনিবার (৮ নভেম্বর) সন্ধ্যায় রাজধানীর একটি হোটেলে ‘সিরামিক বাংলাদেশ ম্যাগাজিন’ আয়োজিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তিনি এসব কথা বলেন। সেমিনারের শিরোনাম ছিল ‘বিটুইন ইরোশন অ্যান্ড ইমারজেন্সি’ (Between Erosion and Emergency)।
মেরিনা তাবাসসুম বলেন, ‘স্থাপত্য মানে কেবল ইট-পাথরের দেয়াল নয়, এটি মানুষের জীবনযাপন, তাদের স্বপ্ন ও টিকে থাকার গল্পের সঙ্গে জড়িত। আমাদের কাজ এমন হতে হবে যা এই মাটির বাস্তবতার সঙ্গে গভীরভাবে মিশে থাকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়ণ এবং মানুষের জীবনধারার পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্থাপত্যের ভাষা বদলাতে হবে। স্থপতিদের এখন এমন ধারণায় কাজ করতে হবে যা প্রকৃতির সঙ্গে সংঘাত নয়, বরং সহাবস্থান নিশ্চিত করে।’
চরাঞ্চল, উপকূলীয় এলাকা ও নদীভাঙনপ্রবণ অঞ্চলের মানুষের জীবনের কথা উল্লেখ করে মেরিনা তাবাসসুম বলেন, ‘চরাঞ্চলের মানুষ প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকে। তাদের জীবনযাপন ও বাসস্থানকে টেকসইভাবে গড়ে তুলতে স্থাপত্যে নতুন ধারণা প্রয়োগ জরুরি। তারা প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে, কিন্তু আমরা স্থপতিরা যদি প্রকৃতির সঙ্গে বোঝাপড়া করতে পারি, তাহলে মানুষের টিকে থাকা আরও সহজ হবে।’
মেরিনা তাবাসসুম জানান, তাঁর নেতৃত্বে কাজ করা দল ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা এবং পুনর্বাসনযোগ্য ঘর তৈরির জন্য নানা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এসব প্রকল্পে স্থানীয় মানুষকে যুক্ত করে তাদের চাহিদা ও জীবনযাপনের ধরন অনুযায়ী নকশা তৈরি করা হচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য শুধু স্থাপনা নির্মাণ নয়।
তিনি বলেন, ‘বরং মানুষের সঙ্গে তাদের পরিবেশের এক ভারসাম্য সৃষ্টি করা। চরাঞ্চলের মানুষকে আত্মনির্ভরশীল করে তুললেই প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব।’
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সিরামিক বাংলাদেশ ম্যাগাজিনের সিনিয়র অ্যাডভাইজর ও আরকিকানেক্টের প্রতিষ্ঠাতা স্থপতি জালাল আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের স্থাপত্য আজ বিশ্বে নিজস্ব অবস্থান তৈরি করেছে। আমাদের স্থপতিরা স্থানীয় বাস্তবতা ও পরিবেশকে গুরুত্ব দিয়ে এমন সব কাজ করছেন যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হচ্ছে। মেরিনা তাবাসসুম সেই ধারার উজ্জ্বল প্রতিনিধি। তাঁর কাজ আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।’
অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন স্থপতি মৌসুমী আহমেদ। পরে স্থপতি মাহমুদুল আনোয়ার রিয়াদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন প্রফেসর জয়নাব ফারুকী আলী, স্থপতি নাহাস আহমেদ খলিল ও প্রফেসর ফুয়াদ হাসান মল্লিক।
আলোচকরা বলেন, ‘বাংলাদেশের স্থাপত্য এখন এমন এক যুগে প্রবেশ করেছে যেখানে স্থানীয় উপকরণ, জলবায়ু ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে নতুন এক স্থাপত্য ভাবনা তৈরি হচ্ছে। তারা মনে করেন, দেশের ভবিষ্যৎ স্থাপত্যচর্চায় টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশবান্ধব দৃষ্টিভঙ্গি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।’
সমাপনী বক্তব্যে বিসিএমইএ প্রেসিডেন্ট ও মুন্নু সিরামিকের ভাইস চেয়ারম্যান মইনুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের স্থাপত্য ও সিরামিক শিল্প একে অপরের পরিপূরক। এই দুই খাত শিল্প, শিক্ষা ও গবেষণার সমন্বয়ে আরও শক্তিশালী হতে পারে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের সিরামিক পণ্যের সুনাম বাড়ছে এখন স্থপতি ও শিল্প উদ্যোক্তাদের যৌথ উদ্যোগে এটিকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া দরকার।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্থাপত্য হচ্ছে এমন এক শিল্প যেখানে বিজ্ঞান, নান্দনিকতা ও মানবকল্যাণ একত্রিত হয়। তাই স্থপতিদের শুধু ভবন নির্মাণ নয়, ভবিষ্যৎ সমাজ নির্মাণেও ভূমিকা রাখতে হবে।’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দেশের প্রখ্যাত স্থপতি, প্রকৌশলী, শিল্প উদ্যোক্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, স্থাপত্য শিক্ষার্থী ও সিনিয়র সাংবাদিকরা। অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্থপতিরা এখন বিশ্বের উদাহরণ হতে পারে, কারণ তারা সীমিত সম্পদ ও কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও প্রকৃতিবান্ধব সমাধান খুঁজে পাচ্ছেন।
সেমিনার শেষে আয়োজক প্রতিষ্ঠান ‘সিরামিক বাংলাদেশ ম্যাগাজিন’-এর পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা ভবিষ্যতে দেশীয় স্থাপত্য, সিরামিক শিল্প ও ডিজাইন উদ্ভাবন নিয়ে ধারাবাহিক কর্মশালা আয়োজন করবে। অনুষ্ঠানে শিল্প, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের মিলন যেন এক নতুন বার্তা দিয়েছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন টেকসই স্থাপত্য চিন্তার মাধ্যমেই এগিয়ে যাবে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন