বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কাছে নরসিংদীর মাধবদীতে গতকাল শুক্রবার যে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছিল, তাতে কেঁপে ওঠে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ। ভূমিকম্পের জেরে এখন পর্যন্ত মারা গেছে অন্তত দশজন, আর আহত হয়েছে পাঁচশোর বেশি মানুষ।
ঢাকা থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে নরসিংদীর জেলার মাধবদী উপজেলায় মাটির প্রায় ১০ কিলোমিটার গভীরে ৫.৭ মাত্রার ওই ভূমিকম্পের শক্তি জমছে বলে জানিয়েছে দেশি-বিদেশি সংস্থা ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক সংস্থা ইউএসজিএস-এর মতে, বাংলাদেশের প্রায় ৭ কোটি মানুষ মৃদু বা হালকা ঝাঁকুনি অনুভব করেছেন।
গতকাল সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী ভূমিকম্পটিকে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হিসেবে বর্ণনা করেছে বাংলাদেশের আবহাওয়া বিভাগ।
এরপর আজ শনিবার সকালে ফের মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, এছাড়াও এদিন সন্ধ্যায় পরপর দুবার ভূমিকম্প অনুবূত হয়েছে।
সকালের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদী হলেও সন্ধ্যায় তা পরিবর্তন হয়ে দেখানো হয় রাজধানীর বাড্ডায়।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, মাধবদীর যে ভূমিকম্প সারা দেশে, বিশেষ করে ঢাকায় যে তীব্র আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে, তার কারণ কি? বা ঢাকা শহরে ব্যাপক ঝাঁকুনি দেয়া এই ভূমিকম্প সম্পর্কে আরও কী জানা যাচ্ছে?
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন, মাধবদীর ভূমিকম্পের কারণ হলো ভূগর্ভে ভারতীয় প্লেট ও বার্মিজ প্লেটের অবস্থান পরিবর্তন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূতাত্ত্বিক চলমান প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ কয়েকটি টেকটনিক প্লেটে বিভক্ত, যেগুলো ভূগর্ভের তরল পদার্থের ওপর ভাসছে এবং এই প্লেটগুলো একে অপরের সাপেক্ষে অবস্থান পাল্টাচ্ছে।
তবে এর বাইরে অনেক জায়গায় সাব-প্লেটও সক্রিয়। যেসব স্থানে একটি প্লেট আরেকটি প্লেটের কাছে মিশেছে বা ধাক্কা দিচ্ছে বা ফাটল তৈরি হয়েছে, সেটাকে বলা হয় ফল্ট লাইন। বাংলাদেশে এমন কয়েকটি ফল্ট লাইন রয়েছে।
এই প্লেটগুলো যখন সরে যায় বা নড়াচড়া করতে থাকে, কিংবা অন্যদিকে ধাক্কা দেয়, তখন একটি ধরনের শক্তি সঞ্চিত হতে থাকে।
সেই শক্তি যখন শিলার ধারণক্ষমতার সীমা অতিক্রম করে, তখন আগে থেকে থাকা বা নতুন তৈরি হওয়া ফাটল বা শিলা ব্লক একে অপরের উপরে উঠে গেলে সেখানে সঞ্চিত শক্তি বের হয়ে ভূ-পৃষ্ঠে কম্পন অনুভূত হয়। মূলত এটিই ভূমিকম্প।
ইউএসজিএস-এর মতে, শুক্রবার বাংলাদেশের যে অঞ্চলে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছে, সেখানে ১৯৫০ সালের পর থেকে এ ধরনের ৫.৫ মাত্রা বা তার বড় ভূমিকম্প হয়েছে ১৪টি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের প্রধান উৎস দুটি। এর একটি হলো 'ডাউকি ফল্ট', যা ভারতের শিলং-মালভূমির পাদদেশে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ-জামালগঞ্জ-সিলেট অঞ্চলে বিস্তৃত, প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ।
আরেকটি হলো: সিলেট থেকে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, টেকনাফ পর্যন্ত, যা সব মিলিয়ে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই উৎসটিকে বিশেষভাবে ভয়ঙ্কর মনে করা হয়।
টেকটনিক প্লেটে বাংলাদেশের অবস্থান অনুযায়ী, দুটি প্লেটের সংযোগস্থল রয়েছে—পশ্চিমে ভারতীয় প্লেট এবং পূর্বে বার্মা প্লেট। বাংলাদেশের উত্তরে আছে ইউরেশিয়ান প্লেট।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন, ভারতীয় প্লেটটি ধীরে ধীরে পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বার্মা প্লেটের নিচে অর্থাৎ চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে।
"তলিয়ে যাওয়ার কারণে একটি সাবডাকশন জোন তৈরি হয়েছে। এবং এই জোনের ব্যাপ্তি সিলেট থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত। পুরো চট্টগ্রাম অঞ্চল এর মধ্যে পড়েছে। এখানে বিভিন্ন সেগমেন্ট আছে। আমাদের এই সেগমেন্টে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার শক্তি জমে আছে। এটি বের হওয়া বাধ্য," তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন।
তিনি আরও বলেন, নরসিংদীর মাধবদীতে যে ভূমিকম্পের উৎস ছিল, তা এই সেগমেন্টেরই এবং নরসিংদীতে দুই প্লেটের সংযোগস্থলেই ভূমিকম্প হয়েছে।
‘এখানে প্লেট লকড ছিল। এর অতি সামান্য অংশ খুলে যাওয়ায় শুক্রবারের ভূমিকম্প হয়েছে। এটি নির্দেশ দেয় যে, সামনে বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা আছে।’
শুক্রবার মাধবদী ভূমিকম্পের পর শনিবার একই জেলার পলাশ উপজেলায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, যার মাত্রা রিখটার স্কেলে ৩.৩ বলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবাইয়াত কবির জানিয়েছেন।
৮০০ বছর ধরে শক্তি জমছে
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই প্লেটের সংযোগস্থলে শক্তি সঞ্চয় হচ্ছে আটশ বছরের বেশি সময় ধরে। সেখানে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার ভূকম্পন সৃষ্টির মতো শক্তি জমে আছে।
তিনি আরও বলেছেন, ‘এটি অবশ্যই বের হবে। মাধবদীর ভূমিকম্পের কারণে এখন সহজেই সেই শক্তি বের হতে পারে। এবং এটি হলে ঢাকা নগরী একটি বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। তাই দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।’
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের এই অঞ্চলে পূর্বেও বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে; এমনকি ভূমিকম্পে নদীর গতিপথও বদলেছে। তবে এসব ঘটনা সিলেট ও চট্টগ্রামের মূল ভূমিকম্প উৎসের বাইরে ঘটেছে।
১৭৯৭ সালে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ বদলেছে। এখনকার মেঘনা নদী এক সময় লালমাই পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে প্রবাহিত হতো। বড় ধরনের ভূমিকম্পে এই নদীর গতিপথও ২০ থেকে ৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে সরে যায়।
১৭৬২ সালে টেকনাফ থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে সেন্টমার্টিন দ্বীপ তিন মিটার উপরে উঠে আসে। সিলেটের মৌলভীবাজার ও কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে ১৯২২ সালে ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। এর আগে ১৮৬৮ সালে এই অঞ্চলে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটেছিল।
ডাউকি ফল্টের ওই অঞ্চলে, জৈন্তাপুর-সুনামগঞ্জে ১৮৯৭ সালে ৮.৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে।
তবে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হতে পারে এমন যে কোনো অঞ্চলে বড় ভূমিকম্প হলে, অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে ঢাকায় বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়ে আসছে।

