বৃহস্পতিবার, ০১ মে, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

প্রকাশিত: মার্চ ১৫, ২০২৫, ০৩:৪২ পিএম

বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস

দৃঢ়তা ও সচেতনতায় কমবে অসাধুদের দৌরাত্ম্য

মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

প্রকাশিত: মার্চ ১৫, ২০২৫, ০৩:৪২ পিএম

দৃঢ়তা ও সচেতনতায় কমবে অসাধুদের দৌরাত্ম্য

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

আজ বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে ভোক্তা-অধিকার দিবস ২০২৫। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকই ভোক্তা। একজন ভোক্তা হিসেবে রয়েছে তার ‘বিশেষ অধিকার’। এ অধিকার সংরক্ষণের প্রথম পদক্ষেপ হলো জনসচেতনতা বৃদ্ধি। কিন্তু সে সচেতনতা সৃষ্টি না হওয়ায় ভোক্তারা পদে পদে বঞ্চিত হচ্ছে তাদের অধিকার থেকে।

১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি কংগ্রেসে ভোক্তার স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে বক্তৃতা দেন। ভোক্তার চারটি অধিকারের ওপর তিনি আলোকপাত করেন। এগুলো হলো- নিরাপত্তার অধিকার, তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার, পছন্দের অধিকার এবং অভিযোগ প্রদানের অধিকার। ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘ কেনেডি বর্ণিত চারটি মৌলিক অধিকারকে আরও বিস্তৃত করে অতিরিক্ত আরও আটটি মৌলিক অধিকার সংযুক্ত করে।

কেনেডির ভাষণের দিনকে স্মরণীয় করে রাখতে দিনটিকে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস হিসেবে বৈশ্বিকভাবে পালন করা হয়। আর ‘ভোক্তা’ শব্দের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। ভোক্তার ইংরেজি শব্দ- কনজ্যুমার যার অর্থ ভোগকারী। অর্থাৎ যখন কেউ কোনো পণ্য বা সেবা গ্রহণ করে অর্থাৎ যারা ভোগ করে তাদের ভোক্তা বলা হয়। 

দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ-২০০৯-এর আওতায় ভোক্তা হলেন- ‘তিনিই যিনি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ব্যতীত, সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করে বা সম্পূর্ণ বাকিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন অথবা কিস্তিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন’। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ কোনো না কোনোভাবে একজন ভোক্তা।

আবার অনেকে বলে থাকেন, মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে যেসব অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা রাষ্ট্র ও জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত- এগুলো ভোক্তা অধিকারের আওতায় পড়ে।

জাতিসংঘ স্বীকৃত ভোক্তা অধিকারগুলোর মধ্যে অন্ন-বস্ত্র, শিক্ষা-চিকিৎসা ও বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, নিরাপদ পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার, পণ্যের উপাদান, ব্যবহারবিধি, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি তথ্য জানার অধিকার, যাচাই-বাছাই করে ন্যায্যমূল্যে সঠিক পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার, কোনো পণ্য বা সেবা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার, অভিযোগ করা ও প্রতিনিধিত্বের অধিকার, ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষালাভের অধিকার, স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ ও বসবাস করার অধিকার অন্যতম। 

তবে অধিকারের পাশাপাশি কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বলা হলেও এসব বিষয়েও আমাদের অজ্ঞতা কম নয়। বিষয়গুলো হলো- পণ্য বা সেবার মান ও গুণাগুণ সম্পর্কে সচেতন এবং জিজ্ঞাসু হোন, দরদাম করে সঠিক পণ্যটি বাছাই করুন, আপনার আচরণে অন্য ক্রেতা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন সে ব্যাপারে সচেতন থাকুন। 

তাই বাংলাদেশে ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণ ও ভোক্তা-অধিকারবিরোধী কাজ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালে সরকার ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করে। এ আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। 

প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভোক্তা স্বার্থ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এ অধিদপ্তর। একটি দেশে নাগরিকদের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য রাষ্ট্র নাগরিকদের কিছু অধিকার নিশ্চিত করে থাকে, যেগুলোকে বলা হয় নাগরিক অধিকার। আর এ নাগরিক অধিকারগুলোর মধ্যে ভোক্তা অধিকার অন্যতম।

একজন নাগরিকের বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন। এর কিছু প্রদান করে থাকে পরিবার, কিছু করে রাষ্ট্র। তবে অন্যান্য অধিকার থেকে ভোক্তা অধিকার কিছুটা ভিন্ন।

যিনি উৎপাদিত পণ্য ও সেবা চূড়ান্ত ভোগের জন্য ক্রয় করেন, অর্থনীতির ভাষায় তাকে ভোক্তা বলে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, যিনি কোনো পণ্য ক্রয় করেন কেবল নিজে ভোগ করার জন্য; তিনিই ভোক্তা।

একজন ব্যক্তি যখন কোনো পণ্য ক্রয় করেন, তখন তার জানার অধিকার রয়েছে পণ্যটি কবে উৎপাদিত হয়েছে, কোথায় উৎপাদিত হয়েছে এবং এর কাঁচামাল কী কী, মূল্য কত ইত্যাদি।

এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে একজন বিক্রেতা বাধ্য। যদি কোনো বিক্রেতা এসব প্রশ্নের উত্তর না দেন বা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন, তখন আইন অনুযায়ী তাতে ভোক্তা অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। জাতিসংঘ স্বীকৃত ভোক্তা অধিকার ৮টি।

এগুলো হলো- মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, তথ্য পাওয়ার অধিকার, নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়ার অধিকার, পছন্দের অধিকার, জানার অধিকার, অভিযোগ করা ও প্রতিকার পাওয়ার অধিকার, ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভের অধিকার, সুস্থ পরিবেশের অধিকার।

বর্তমানে অনলাইনে কেনাকাটা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কিন্তু ওয়েবসাইটে পণ্যের যে মান উল্লেখ থাকে, মূল্য পরিশোধের পর পণ্য হাতে পেয়ে দেখা যায়- বর্ণিত গুণাগুণ সেই পণ্যের মধ্যে নেই। তাই ভোক্তাকে  আইন সম্পর্কে জানতে হবে এবং নির্ধারিত পন্থায় অভিযোগ দায়ের করতে হবে।

তাহলেই অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য কমবে এবং ভোক্তাদের প্রতারিত হওয়ার সংখ্যাও কমে আসবে। আর ২০০৯ সালে প্রণীত ভোক্তা অধিকার আইনে মোট ৮২টি ধারা রয়েছে। এ ছাড়াও কয়েকটি ধারার উপধারা রয়েছে। 

আমি ভোক্তা অধিকার আইনের উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় তুলে ধরতে চাই। ৩৭ ধারা মোতাবেক পণ্যের মোড়ক না থাকলে বা মোড়কে পণ্যের তথ্য না থাকলে বিক্রেতা অনধিক ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

৩৮ ধারায় পণ্যের দাম সহজে দৃশ্যমান কোনো স্থানে না রাখলে ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। ৩৯ ধারায় উল্লেখ করা আছে, সেবার দাম সংরক্ষণ এবং সহজে দৃশ্যমান কোনো স্থানে না রাখলে বিক্রেতা অনধিক ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

৪০ ধারা অনুযায়ী, ধার্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে পণ্য, সেবা বা ওষুধ বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

৪১ ধারা অনুযায়ী ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ৩ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। ৪২ ধারা অনুযায়ী খাদ্যপণ্যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো নিষিদ্ধ দ্রব্য মিশিয়ে বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ৩ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

৪৩ ধারায় উল্লেখ আছে, জীবন বা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমন পণ্য অবৈধ উপায়ে বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ২ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

৪৪ ধারায় উল্লেখ আছে, পণ্যের মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা করলে অনধিক ১ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন ইত্যাদি।

পণ্য কিনে প্রতারিত হলে অভিযোগ দায়ের করার পদ্ধতি খুবই সহজ। বর্তমানে প্রত্যেকের হাতে হাতে স্মার্টফোন। গুগোল প্লে-স্টোরে সংরক্ষিত ‘ভোক্তা অধিকার ও অভিযোগ’ অ্যাপসের মাধ্যমে খুব সহজেই প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে অভিযোগ দায়ের করা যায়। আর ২০০৯ সালের আইনটি হওয়ার আগে কমবেশি ৪০টি আইন ও ধারা বিচ্ছিন্নভাবে ভোক্তা অধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। ২০০৯ সালের আইনের মাধ্যমে সবগুলো প্রাসঙ্গিক বিষয় একসঙ্গে করা হয়। 

ভোক্তা অধিকার নিয়ে আরও যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আইন আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো- বিএসটিআই অধ্যাদেশ ১৯৮৫, অত্যাবশ্যক পণ্যসামগ্রী আইন ১৯৫৬, নিরাপদ খাদ্য আইন ১৯৫৯, পণ্য বিক্রয় আইন ১৯৩০, ওজন ও পরিমাপ আইন ১৯৮২ ও এক্রেডিটেশন বোর্ড আইন ২০০৬। সবগুলো আইনেই ভোক্তা অধিকারের কথা বলা আছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন আছে। তারা বহুদিন থেকেই এ ধরনের আইন বাস্তবায়নের সুফল পেয়ে আসছে। নাগরিকদের ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য রাষ্ট্র বিভিন্ন পদক্ষেপও নিয়ে থাকে। একটি কার্যকর ভোক্তা আইনের ফলে সেসব দেশে জনস্বার্থ তথা ভোক্তা অধিকার আজ একটি প্রতিষ্ঠিত বিষয়। 

ব্যবসা-বাণিজ্য তথা ভোক্তা অধিকারের ক্ষেত্রে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আমরা দাম দিয়ে ভেজাল পণ্য ও সেবা ক্রয় করি। এ নিয়ে নাগরিকরা কোনো প্রতিবাদ করে না। রাষ্ট্রও নির্বিকার। কিন্তু অন্য দেশে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘনের কথা ভাবাও যায় না। 

ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন করলে অনেক দেশে বিক্রেতার লাইসেন্স পর্যন্ত বাতিল করা হয়। শুধু তাই নিয়, আছে ফৌজদারি দণ্ডও। তাই আইনের বাস্তবায়নটাই বড় কথা। যেকোনো দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের প্রথম পদক্ষেপ হলো জনসচেতনতা বৃদ্ধি। কিন্তু আমাদের মাঝে অর্থাৎ ভোক্তাদের মাঝেই সে সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। ফলে, ভোক্তারা পদে পদে বঞ্চিত হচ্ছে তাদের অধিকার থেকে।

মিথ্যাচার, ভেজাল, ফর্মালিন আজ ভোগ্যপণের সঙ্গে মিশে গেছে। এমনকি ওষুধ দিয়ে গরু মোটাতাজা করা হচ্ছে। বাজারের শাক-সবজি, ফল-মূল সব কিছুতেই ফরমালিন।

আইন প্রণয়নের পর বিভাগ, জেলা ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকায় বাজার মনিটরিং ও অভিযোগ নিষ্পত্তির মাধ্যমে এ আইন বাস্তবায়ন কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। এ লক্ষ্যে মাঝে মাঝে গণমাধ্যমে অভিযান পরিচালনার সংবাদ দেখা যায়। এটিকে আংশিকভাবে এ আইন বাস্তবায়নের প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কিন্তু জনগণের দোরগোড়ায় এ আইনকে পৌঁছে দিতে হবে। সচেতন করতে হবে সবাইকে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে দ্রব্যমূল্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদেরকে শিকার করতে হবে যে, বাংলাদেশে যে কটি প্রতিষ্ঠান স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির আওতায় রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। 

যদিও তাদের লোকবল অনেকখানি কম তারপরেও স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির প্রশ্নে তারা বাংলাদেশের অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে একটু আলাদা। আশা করি তারা তাদের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি ধরে রাখবে এবং মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত থাকবে। তাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সচেতন ও সক্রিয় হোন, ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে অধিকার সংরক্ষণে সোচ্চার ও সংগঠিত হোন।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক  
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!