নারী একটি শব্দ, যাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে মানবসভ্যতার এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা প্রতিটি রূপেই নারী আমাদের জীবনের এক অনিবার্য অংশ। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, আজও এই নারীকেই হতে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার। ঘরে, বাইরে, পথে, কর্মস্থলে নারী যেন সর্বত্রই ঝুঁকিতে।
বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই নারীরা আজও নানা ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শারীরিক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। সমাজে একদিকে উন্নয়ন ও পরিবর্তন ঘটলেও নারীর প্রতি সহিংসতা, বৈষম্য ও শোষণ অব্যাহত রয়েছে। কর্মক্ষেত্র, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জনপরিসরে নারীরা প্রায়ই বৈষম্য ও নির্যাতনের সম্মুখীন হন। বিশেষ করে নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন হয়রানি, বাল্যবিবাহ এবং পারিবারিক নির্যাতন আজও আমাদের সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত।
সমাজের একটি বড় অংশ নারীকে দুর্বল হিসেবে দেখে এবং তার অধিকার ও মর্যাদাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে না। এই সমস্যা শুধু শহরেই নয়, গ্রামীণ এলাকাতেও বিদ্যমান, যেখানে নারীরা অনেক সময় মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হন।
সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বোঝা যায় নারী নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র। শুধু নারীরাই যে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তা নয়, কন্যা শিশুরাও বাদ যাচ্ছে না এই নির্যাতনের হাত থেকে। চলতি বছর মাগুরা শহরে বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে আট বছরের শিশু আছিয়া ধর্ষণের শিকার হয়েছিল নির্মম বর্বরতার ধাক্কা সইতে না পেরে তার মৃত্যু হয়। যা সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই সারা দেশে আলোড়ন তোলে কুমিল্লার মুরাদ নগরে এক প্রবাসীর স্ত্রীকে নির্যাতনের পর ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার খবর। শুধু তাই নয়, প্রতিদিনই পত্রিকার পাতায় উঠে আসে একাধিক নারী নির্যাতনের খবর।
সম্প্রতি ধর্ষণের অভিযোগে গাইবান্ধা ও কক্সবাজার জেলায় দুজনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। একই দিনে বরিশাল-ভোলা মহাসড়কের পাশ থেকে হাত-পা বাঁধা ও পলিথিনে পেঁচানো অবস্থায় এসিডদগ্ধ এক নারীকে জীবিত উদ্ধার করেছে বন্দর থানা পুলিশ। এসব ঘটনা আমাদের দেশে নিত্যদিনের।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ২৯৪ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৬ জন, যার মধ্যে ৪৪ জন শিশুও রয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৯ জন নারী। এদের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২১টি এবং সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৮ জন।
মানবাধিকার সংগঠন এমএসএফ মার্চ মাসের এক প্রতিবেদনে বলেছে, ফেব্রুয়ারির চেয়ে মার্চে ধর্ষণের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় দ্বিগুণের বেশি। বাস্তবেও তাই ঘটছে। প্রতিদিনই বাড়ছে নারীর প্রতি সহিংসতা।
নারীর প্রতি সহিংসতার পেছনে রয়েছে সমাজে প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা, আইন প্রয়োগে গাফিলতি, এবং ভিকটিম-ব্লেমিংয়ের মতো অপসংস্কৃতি। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, একজন নারী ন্যায়বিচারের আশায় এগিয়ে এলেও তাকে প্রতিহত করা হয়। বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা, সাক্ষ্য প্রমাণের দুর্বলতা এবং সামাজিক চাপ অনেক নারীকেই চুপ থাকতে বাধ্য করে।
কিন্তু আর কত? এখন সময় এসেছে, আমাদের ঘুম ভাঙার। শুধু আইন করে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা, শিক্ষার আলো এবং নারীর প্রতি সম্মানবোধের চর্চা। পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে সন্তানদের মানবিক শিক্ষা দেওয়া, নারীকে মানুষ হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা। গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সংস্কৃতিক অঙ্গনকে ভূমিকা রাখতে হবে।
সরকারকে আরও কঠোরভাবে বিদ্যমান আইন প্রয়োগ করতে হবে। শুধু গ্রেপ্তারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। দ্রুত বিচার করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হতে হবে আরও সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল। একই সঙ্গে, ভিকটিম সহায়তা কেন্দ্র, কাউন্সেলিং এবং পুনর্বাসনের সুযোগ বাড়াতে হবে।
নারীর প্রতি সহিংসতা কোনো ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, এটি একটি জাতীয় সংকট। এই সংকট সমাধানে আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব রয়েছে। সমাজের প্রতিটি স্তরে নারীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ গড়তে আমাদের সবাইকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে।