আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ২০২৬ সালের রমজানের আগে সম্পন্ন করতে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী ভোটের তারিখের দুই মাস আগে তপশিল ঘোষণা করবে ইসি। নির্বাচন কমিশন আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ বা পথনকশা ঘোষণা করেছে। নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী সংসদ নির্বাচন হবে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে এবং তপশিল ঘোষণা হবে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সংসদ নির্বাচন আয়োজনের এটি আরেক ধাপ অগ্রগতি।
অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন মহল থেকে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানানো হয়েছিল। আমরা ইসির এ ঘোষণাকে স্বাগত জানাই। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নির্বাচনের পথে যাত্রা শুরু করল। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে নির্বাচন কমিশনকে তপশিলের আগেও অনেকগুলো কাজ করতে হয়। রোডম্যাপে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ, ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন ও দেশীয় পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন চূড়ান্ত করাসহ ২৪টি কাজকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) জাতীয় নির্বাচনের যে কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে, সেটাকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ ঘোষণাকে ‘অপরিপক্ব’, ‘আংশিক’ ও ‘কিছুটা বিভ্রান্তিমূলক’ বলে মনে করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। জুলাই সনদ চূড়ান্ত হওয়ার আগে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা সরকারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের শামিল বলে উল্লেখ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
দলটি বলছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত না করে নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ ভবিষ্যতে সংকট তৈরি করতে পারে এবং এর দায় সরকারকেই নিতে হবে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচন সম্পর্কে কোনো শঙ্কা নেই। যদিও কিছু দল বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছে, তবে এটি শুধুই তাদের রাজনৈতিক কৌশল। ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য বজায় রেখে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে উল্লেখ করে এই বিএনপি নেতা বলেন, এই নির্বাচন রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ঘটনা হবে। দেশে এরই মধ্যে নির্বাচনি আমেজ বিরাজ করছে। যে-ই এর বিপক্ষে কথা বলবে, তারা নিজেদের রাজনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদের কারণে বহুল আলোচিত জুলাই সনদ জুলাই মাসে চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি । এখনো রাজনৈতিক দলগুলো সনদের বিষয়ে একমত হতে পারছে না; এটা অবশ্যই উদ্বেগের কারণ। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদের সর্বশেষ যে খসড়া রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠিয়েছে, তা নিয়ে নতুন জটিলতা তৈরি হয়েছে। মূল সমস্যা এখানে নয়। সনদের বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া তথা আইনি ভিত্তি নিয়েই বড় ধরনের বিরোধ দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রাথমিক খসড়ায় বলা হয়েছে, পরবর্তী জাতীয় সংসদ দুই বছরের মধ্যে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কিছু দল এ ব্যাপারে আপত্তি জানায়। তাদের মতে, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না থাকলে পরবর্তীকালে এটি গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে।
সমঝোতায় পৌঁছাতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ আরও এক মাস বাড়ানো হয়েছে, যা সেপ্টেম্বর মাসের ১৫ তারিখ শেষ হওয়ার কথা। হাতে যেহেতু বেশি সময় নেই, তাই আলোচনা দ্রুত শেষ করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে সরকার বা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের যেমন- দায়িত্ব আছে, তেমনি দায়িত্ব আছে রাজনৈতিক দলগুলোরও। ভবিষ্যতে রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে, সে বিষয়ে তাদের ঐকমত্যে আসতেই হবে। এ অবস্থায় কোনো দলের এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে নির্বাচনপ্রক্রিয়া শুরু করতে বিলম্ব হয়। দেশবাসী একটি অবাধ, সুষ্ঠু, উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। এ অপেক্ষা দীর্ঘায়িত করার কোনো সুযোগ নেই। রাজনৈতিক দলগুলো যদি শুধু নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে এবং সংস্কার বাস্তবায়ন না করে, তাহলে এর মাশুল তাদের দিতে হবে। এর সঙ্গে হয়তো নাগরিকদেরও মাশুল দিতে হবে। সেই মাশুল যেন নাগরিকদের দিতে না হয়।
জুলাই জাতীয় সনদ থেকে কয়েকটি প্রাপ্তি হলো যেমন- মৌলিক অধিকারগুলোর সম্প্রসারণ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রক্রিয়া, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় লাগাম টানা, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, সংবিধানের উচ্চকক্ষপ্রতিষ্ঠা ও সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন, জাতীয় সংসদে দলের বিরুদ্ধে ভোটদান, সংসদের স্থায়ী কমিটির সভাপতি, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ও বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ ইত্যাদি। জুলাই সনদের অপ্রাপ্তির বিষয়গুলো হলো জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের মাধ্যমে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব, বৃহত্তর নির্বাচকম-লীর গোপন ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, স্থানীয় সরকারে ঘূর্ণমানপদ্ধতিতে নারীর আসন সংরক্ষণ ইত্যাদি। জাতীয় সংসদে নারীদের ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি, যা হতাশাজনক। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের মধ্য দিয়ে প্রণীত জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু এর সার্থকতা নির্ভর করবে বাস্তবায়নের ওপর, যা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতভেদ আছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আশা করা যায়, এ বিষয়ে দ্রুত একটি সমাধানে পৌঁছাবে ঐকমত্য কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলো।
আমরা মনে করি, সংস্কারের কোনগুলো সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে, কোনগুলো অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে, কোনগুলো প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বাস্তবায়ন করা হবে এবং এর মধ্যে কোনগুলো আশু বাস্তবায়নযোগ্য, তা আলাদা করা দরকার। অতীতের তিনটি নির্বাচনে জনগণের রায়ের প্রতিফলন ঘটেনি। এগুলোর কোনোটি বিনা ভোটের নির্বাচন ছিল, কোনোটিতে দিনের ভোট রাতে হওয়ার গুরুতর অভিযোগ আছে। এ অবস্থায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করা কমিশনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আর সেই চ্যালেঞ্জ তারা তখনই করতে পারবে, যখন প্রশাসন, সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সার্বিক সমর্থন ও সহযোগিতা পাবে। আগের তিনটি নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হওয়ায় কমিশনের প্রতি ক্ষমতাসীনদের চাপ ছিল। বর্তমানে নির্দলীয় ও অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন নির্বাচন হওয়ায় সে ধরনের চাপের আশঙ্কা কম। কিন্তু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর চাপ থাকবে, যার আলামত এখনই পাওয়া যাচ্ছে। ইসির কোনো সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে তাকে প্রতিপক্ষের দোসর হিসেবে চিহ্নিত করা রাজনৈতিক দলগুলোর অসহিষ্ণু মনোভাবেরই প্রকাশ বলে মনে করি।
নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি সরকারের জন্য সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরিতে রাজনৈতিক দলগুলোরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া জুলাই সনদের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো এখনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দফায় দফায় বৈঠক করেও সমঝোতায় আসতে পারেনি। আমরা মনে করি, নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার পর রাজনৈতিক দলগুলোর মনস্তাত্ত্বিক চাপও বাড়ল।
নেতারা জুলাই সনদের দাঁড়ি-কমা নিয়ে যতই বাহাস করুন না কেন, জনগণ ভোটের জন্য উন্মুখ। সমঝোতার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাই মুখ্য। ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য দেশের মানুষ ১৬ বছর সংগ্রাম করেছে। বুকের রক্ত দিয়েছে। বর্তমান যখন সেই ভোটাধিকারের একটি রাস্তা সুগম হয়েছে, সবাই আশায় বুক বেঁধেছেন, সেই রাস্তায় যেন কোনো কাঁটা বিছানো না হয়। বিচার, সংস্কার, নির্বাচন এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রধান জাতীয় স্বার্থ। বিচার ও সংস্কারকে দাঁড় করানো কোনোভাবেই ঠিক হবে না।
নির্বাচন যেটা আমাদের সংস্কার সম্পন্ন করার জন্যই দরকার। গণতান্ত্রিক উন্নয়নের মাধ্যমেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে বলে বিশ্বাস করি আমরা। নির্বাচনের মাধ্যমে সংস্কারের যে জায়গায় আমরা পৌঁছেছি, একটি জাতীয় সনদ প্রস্তুত হয়েছে, সেই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা, জাতীয় সনদের আইনি বাধ্যবাধকতা ও তার বাস্তবায়নের পথ নিয়ে রাজনীতি দলগুলো সন্দেহ সংশয় বিরোধ, মতদ্বৈততা কাটিয়ে দ্রুত ঐকমত্যে পৌঁছে যাবে।
রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক 

 
                             
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       -20251025002118.webp) 
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন