বর্তমানে প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবন অনেক সহজ ও গতিশীল হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই সুবিধার পাশাপাশি এসেছে এক অদৃশ্য হুমকি সাইবার অপরাধ। দিনে দিনে এই অপরাধের ধরন যেমন বদলাচ্ছে, তেমনি বাড়ছে এর মাত্রাও। বিশেষ করে নারীরা এখন সবচেয়ে বেশি এই অপরাধের শিকার হচ্ছেন। প্রশ্ন উঠছে কেন নারীরাই সাইবার অপরাধীদের প্রধান লক্ষ্য? এর পেছনে রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক, প্রযুক্তিগত এবং সামাজিক বিভিন্ন কারণ।
নারীরা প্রযুক্তিতে বেশি সক্রিয়, অপরাধীর নজরেও বেশি
বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে নারীরা এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয়। তারা ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ইউটিউব ব্যবহার করছেন প্রতিনিয়ত। ছবি শেয়ার, স্টোরি দেওয়া, লোকেশন আপডেট, ভিডিও পোস্ট এসব কিছুই যেন এখন জীবনের অংশ।
এই সবকিছুতেই থেকে যায় অসতর্কতার ছাপ। অপরাধীরা ঠিক সেখানেই আঘাত হানে। তারা তথ্য সংগ্রহ করে, ছবি ডাউনলোড করে, তারপর সেগুলোকে বিকৃত করে তৈরি করে ফেক আইডি, মিম বা ব্ল্যাকমেইলিং কনটেন্ট। একজন নারী জানতেও পারেন না যে, তার ফেসবুক প্রোফাইলই আজ একটি সাইবার অপরাধের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
ছবির অপব্যবহার ও ফটোশপের ভয়াল চিত্র
অনেক সময় নারীদের প্রোফাইল ছবি নিয়ে অপরাধীরা ফটোশপের মাধ্যমে তৈরি করে নগ্ন বা অশ্লীল ছবি। এরপর শুরু হয় ভয় দেখানো বা টাকা দাবি করা। না দিলে ছবি ভাইরাল করে দেওয়া, পরিবারের কাছে পাঠানোর ভয় দেখানো হয়। অনেক সময় এই চাপে নারী আত্মহত্যার পথ পর্যন্ত বেছে নেন।
ঘটনা উদাহরণ: ঢাকার এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নিজের প্রোফাইল থেকে শেয়ার করা ছবির কারণে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হন। অপরাধীরা দাবিকৃত টাকা না দিলে তার নগ্ন ছবি ভাইরাল করে দেয় যা পরিবার, বন্ধুবান্ধব, এমনকি শিক্ষক পর্যন্ত দেখে ফেলেন।
অপরিচিত বন্ধুত্ব: ‘লাভ স্ক্যাম’ এর ফাঁদ নারীরা সহজ-সরলভাবে কারও বন্ধুত্ব গ্রহণ করেন। অপরিচিত পুরুষ মিষ্টি কথায় সম্পর্ক গড়ে তোলে। কিছুদিন পর ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও চায়। বিশ্বাস করে নারী তা পাঠিয়ে দেন। এরপর শুরু হয় ব্ল্যাকমেইলিং।
এই ধরনের অপরাধকে বলা হয় “Loverboy Scam” বা “Sextortion”। এরা শুধু অর্থ নয়, নারীর মানসিক স্বাস্থ্য ধ্বংস করে দেয়।
নারীর ভয়ই অপরাধীদের অস্ত্র
নারীরা অনেক সময় সামাজিক সম্মান বা পরিবারের ভয়ে বিষয়টি চেপে যান। পুলিশে অভিযোগ করেন না। ফলে অপরাধীরা আরও সাহস পায়। তারা জানে, একজন নারীর পক্ষে চুপ থাকাই সহজ। এই চুপ থাকাকেই তারা ব্যবহার করে আরও অনেক নারীকে টার্গেট করতে।
সাইবার অপরাধীদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা
সাইবার অপরাধীরা শুধু ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ নয়। তারা হোয়াটসঅ্যাপ, ইমেইল, ভুয়া ওয়েবসাইট, ক্লোনিং অ্যাপস সব কিছুতে দক্ষ। তারা ফিশিং লিংক পাঠায়, ক্লিক করলেই নারীর ফোন হ্যাক হয়ে যায়। এরপর ফোনের গ্যালারি, কনট্যাক্ট, চ্যাট সব তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
নারীদের কীভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে?
১. সচেতনতা ও ডিজিটাল লিটারেসি:
- অজানা বা অপরিচিত লিংকে ক্লিক নয়।
- প্রাইভেসি সেটিংস সবসময় সিকিউর করে রাখা।
- কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত তথ্য বা ছবি শেয়ার না করা।
২. প্রোফাইল নিরাপদ রাখা:
প্রোফাইল ছবি প্রাইভেট করুন বা বন্ধু ব্যতীত অন্যদের জন্য লুকিয়ে রাখুন।
Two-Step Verification চালু রাখুন।
লোকেশন শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন।
৩. পুলিশের কাছে অভিযোগ করুন:
বাংলাদেশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট (CID / CTTC) এখন অনেক সক্রিয়।
৯৯৯ নম্বরে ফোন করতে পারেন, অথবা www.police.gov.bd ওয়েবসাইটে অভিযোগ জানান।
প্রয়োজনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুসারে মামলা করা যায়।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান: নারীরা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী
বাংলাদেশ পুলিশের সাইবার ইউনিটের তথ্য মতে, ৭০ শতাংশ সাইবার অপরাধের শিকার নারী।
এর মধ্যে ৬০ শতাংশই ১৮–৩৫ বছর বয়সী।
প্রায় ৪০ শতাংশ নারী ভয়ে অভিযোগই জানান না।
সমাজ ও পরিবারের দায়িত্ব কী?
ভুক্তভোগী নারীর পাশে দাঁড়াতে হবে।
তাকে দোষ না দিয়ে সাহস দিতে হবে।
পরিবারকে বোঝাতে হবে, প্রযুক্তি ব্যবহারে নারীর অধিকার রয়েছে—তবে সচেতনভাবে।
মানসিক স্বাস্থ্য: সাইবার অপরাধের আরেকটি আঘাত
সাইবার অপরাধ শুধু সামাজিক নয়, মানসিকভাবেও নারীদের ধ্বংস করে। অনেকে হতাশায় ভোগেন, পড়ালেখা বা কাজ বন্ধ করে দেন, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে প্রয়োজন পরামর্শ, কাউন্সেলিং, পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সহযোগিতা।
ভবিষ্যতের করণীয়
স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগে নারী সাইবার হেল্প ডেস্ক তৈরি করতে হবে।
নারীদের জন্য সরাসরি সহায়তা নম্বর ও মোবাইল অ্যাপ চালু করা উচিত।
সাইবার অপরাধ থেকে নারীদের রক্ষা করা শুধু তাদের একার কাজ নয় এটি সমাজের, রাষ্ট্রের এবং পরিবারের সম্মিলিত দায়িত্ব। প্রযুক্তি ব্যবহারে নারীদের টার্গেট করা এক ভয়ংকর অপরাধ, যা কঠোরভাবে প্রতিরোধ করতে হবে।
নারীরা দুর্বল নন সাহস, সচেতনতা আর প্রযুক্তিগত দক্ষতার মাধ্যমেই তারা হয়ে উঠতে পারেন “সাইবার সুরক্ষিত নারী”। সাইবার অপরাধীরা যেন আর কখনও নারীদের সহজ টার্গেট না ভাবতে পারে, সেজন্য সময় এসেছে সবাইকে একসঙ্গে দাঁড়ানোর।
আপনার মতামত লিখুন :