ঢাকা শুক্রবার, ২৩ মে, ২০২৫

ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনে বেশির ভাগ দল একমত, ভিন্ন সুর শুধু এনসিপির

রুবেল রহমান ও এফ এ শাহেদ
প্রকাশিত: মে ২৩, ২০২৫, ০১:৫০ এএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

নির্বাচন, সংস্কার, মানবিক করিডর, বন্দরসহ বিভিন্ন ইস্যুতে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে নানা মহলে চলছে সমালোচনার ঝড়। ‘আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত’ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের মন্তব্য এই সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

ঢাকা সেনানিবাসের সেনাপ্রাঙ্গণে অফিসার্স অ্যাড্রেসে গত বুধবার সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সেনাবাহিনী এখন আরও কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে। সংঘবদ্ধ জনতার নামে বিশৃঙ্খলা বা সহিংসতা আর সহ্য করা হবে না।’ নির্বাচনের সময় নিয়ে এমন মন্তব্যে অধিকাংশ রাজনীতিক দল সহমত বা একমত পোষণ করলেও সেনাপ্রধান নির্বাচনের বিষয়ে কথা বলার সঠিক ব্যক্তি কি নাÑ এমন প্রশ্ন তুলেছে এনসিপি-জাতীয় নাগরিক পার্টি।

সেনাপ্রধানের নির্বাচন নিয়ে বক্তব্যে সঠিক দিকনির্দেশনা দেননি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তবে দুই উপদেষ্টা সম্পর্কে তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ করা উচিত। সম্ভব হলে আজই পদত্যাগ করা উচিত। তাদের আর একদিনও থাকা উচিত নয়, তারা একটা দলের সাথে যুক্ত, এটা কে না জানে? তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার একটি বিশেষ দলকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে, তা পরিষ্কার। অরাজনৈতিক শক্তি দীর্ঘদিন থাকলে পতিত স্বৈরাচার সুযোগ নেবে। ডিসেম্বরে নির্বাচনের উপযুক্ত সময়। অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ১৭ মাস মোটেও কম সময় নয়।’

ফলে এই ঐক্যের শক্তির উপরে দাঁড়িয়ে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় সংস্কার ও নির্বাচনের পথরেখা তৈরি করতে হবে। জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ইত্যাদি প্রশ্নে জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতেই এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

সেনাপ্রধানের মন্তব্যে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘সব রাজনৈতিক দলের চাওয়া ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বর্তমান দেশের নৈরাজ্যসহ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবং উন্নয়নে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া যুক্তিযুক্ত। সেনাপ্রধানের এই বক্তব্যকে সাধুবাদ জানাই।’

এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক অনিক রায় রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন চায়। তবে, আমরা লক্ষ্য করছিÑ এনসিপিকে নির্বাচনবিরোধী আখ্যা দিয়ে সচেতনভাবে এক ধরনের কলঙ্ক দেওয়ার চেষ্টা চলছে। নির্বাচন নিয়ে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট। প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত যে সময় দিয়েছেন, আমরা সেটিকে সমর্থন করেছি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবেই। সেখানে সেনাপ্রধান নির্বাচনের সময় নিয়ে মন্তব্য করার জন্য সঠিক ব্যক্তি কি না আমাদের ভাবতে হবে!’ 

তিনি বলেন, ‘সেনাপ্রধানের ব্যক্তিগত মতামত থাকলে তিনি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করতে পারতেন। সেনাবাহিনী আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সদাসতর্ক পাহারাদার। দেশের প্রয়োজনে, সার্বভৌমত্বের প্রয়োজনে আমরা সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করব। তবে নির্বাচন-রাজনীতি নিয়ে সেনাপ্রধানের এমন মন্তব্য কতটুকু যৌক্তিক, তা ভাবতে হবে।’ 

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি শাহ আলম রূপালী বাংলাদেশ বলেন, ‘নির্বাচন সেনাবাহিনী বা বিএনপি কিংবা অন্য কোনো দলের বিষয় নয়। স্থিতিশীল জায়গায় নিয়ে যেতে হলে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিতে হবে। মানুষ দমবন্ধ অবস্থায় আছে, তারা দ্রুত গণতান্ত্রিক নির্বাচন চায়। গণতান্ত্রিক সরকার আসলেই এই ভীতিকর পরিস্থিতি কেটে যাবে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষাকে বাস্তব না করে বর্তমান সরকারের একটি অংশ হিডেন (গোপন) এজেন্ডা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তারা অহেতুক নানা ইস্যুকে সামনে এনে জনগণকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিচ্ছেন। এটা জাতির জন্য অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক। এটা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে দেশ আরও সংকটে পড়বে।’ 

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘সেনাপ্রধানের বক্তব্য আমরা ইতিবাচকভাবে দেখছি। তিনি আগেই বলেছেন, দেড় বছরের মাথায় নির্বাচন দেওয়ার কথা। রাজনৈতিক দলগুলো ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের কথা ভাবছে। যদি সম্ভব হয় ডিসেম্বরের আগেও নির্বাচন দেওয়া যেতে পারে। এখন দেখার বিষয় সেনাপ্রধানের এই বক্তব্যকে সরকার কীভাবে নেয়।’

অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্বাচন নিয়ে সেনাপ্রধানের বক্তব্যের সঙ্গে তারা একমত। তারা দাবি করেন, সেনাপ্রধান জনআক্সক্ষাকার কথা বলেছেন। তবে, এনসিপির প্রশ্ন নির্বাচন ইস্যুতে কথা বলার বৈধ্যতা সেনাপ্রধানের আছে কি না? একইসাথে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মতো মন্তব্য কতটা যৌক্তিক সে বিষয়ে ভাবতে বলেন তারা। 

উল্লেখ্য, গত বুধবার ঢাকা সেনানিবাসের সেনা প্রাঙ্গণে অফিসার্স অ্যাড্রেসে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত। দেশের ভবিষ্যৎ পথ নির্ধারণের অধিকার একটি নির্বাচিত সরকারেরই রয়েছে।

নির্বাচন ছাড়া করিডর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডর বিষয়ে সিদ্ধান্ত একটি নির্বাচিত সরকার থেকেই আসতে হবে এবং তা বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই হতে হবে। এখানে জাতীয় স্বার্থ দেখতে হবে। যা করার জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করেই করতে হবে।

‘মব ভায়োলেন্স’ বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংঘবদ্ধ বিশৃঙ্খলা বা আক্রমণের বিরুদ্ধেও কঠোর বার্তা দিয়ে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সেনাবাহিনী এখন আরও কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে। সংঘবদ্ধ জনতার নামে বিশৃঙ্খলা বা সহিংসতা আর সহ্য করা হবে না।

বন্দর প্রসঙ্গে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে দেওয়া নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনা ও বিতর্কের বিষয়ে স্থানীয় মানুষ এবং রাজনৈতিক নেতাদের মতামত প্রয়োজন হবে।  সংস্কার প্রসঙ্গে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, কী সংস্কার হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে, এ বিষয়ে তার কিছু জানা নেই।

এ বিষয়ে তার সঙ্গে কোনো পরামর্শ বা আলোচনা করা হয়নি। এ ছাড়া সেনাপ্রধান তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কখনোই এমন কোনো কার্যকলাপে যুক্ত হবে না, যা জাতীয় সার্বভৌমত্বের জন্য ক্ষতিকর। তিনি সব পর্যায়ের সেনাসদস্যদের নিরপেক্ষ থাকার এবং ভবিষ্যতে নির্বাচনি দায়িত্ব সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালনের নির্দেশ দেন।

এদিন, ঢাকায় অবস্থানরত সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা এতে অংশ নেন। অনেক কর্মকর্তা ভার্চুয়ালি যুক্ত হন। অনুষ্ঠানে নির্বাচন ছাড়াও করিডর, বন্দর, সংস্কারসহ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে। সেখানে উপস্থিত সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এ তথ্যগুলো জানা গেছে।