ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই, ২০২৫

আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে শুরু হচ্ছে যৌথ অভিযান

শহিদুল ইসলাম রাজী
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১, ২০২৪, ১১:১৯ পিএম
ছবি: সংগৃহীত

*লুট হওয়া ও আন্দোলন দমাতে ব্যবহৃত অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে গুরুত্বারোপ
*দেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা অন্তত ৫০ হাজার 
*১০ হাজারের বেশি আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীর 
জমা না দিলে বৈধ অস্ত্রও অবৈধ


আগামী ৪ সেপ্টেম্বর বুধবার থেকে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে শুরু হচ্ছে যৌথ অভিযান। বৈধ অবৈধ ও থানা-ফাঁড়ি থেকে লুণ্ঠিত সব ধরনের অস্ত্র উদ্ধারে সশস্ত্র বাহিনীর সহায়তায় এ যৌথ অভিযান শুরু হবে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশে তৈরি হয় অরাজক পরিস্থিতি। থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে ভাংচুর ও আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। লুট করা হয় পুলিশের অস্ত্র ও গোলাবারুদ। আত্মগোপনে চলে যান ক্ষমতাচ্যুত সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপিসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগের নেতারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, যৌথ বাহিনীর অভিযানে লুট হওয়া অস্ত্র যেমন উদ্ধারে গুরুত্ব দেওয়া হবে, তেমনি ছাত্র আন্দোলনের সময় ব্যবহৃত অবৈধ অস্ত্রেরও সন্ধান করা হবে। কারা এসব অস্ত্রের জোগানদাতা, খোঁজা হবে তাদেরও। এদিকে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স জানিয়েছে, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের দিন খোঁয়া যাওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ৩ হাজার ৮৮০টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া ২ লাখ ৮৬ হাজার ৩৫৩ রাউন্ড গুলি, ২২ হাজার ২০১টি টিয়ার গ্যাসের সেল ও ২ হাজার ১৩৯টি সাউন্ড গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি অস্ত্র উদ্ধারেও থানা পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, আগামী ৪ সেপ্টেম্বর থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করা হবে। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করা হয় বেশকিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ। তবে সে সংখ্যাটাও খুবই নগণ্য। ফলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দিচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটের ঘটনায় দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে এমন আশঙ্কায় এ অভিযান। সেই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার কার্যক্রমসহ নিয়মিত টহল ও নজরদারি অব্যাহত রাখা হবে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেন তিনি।

এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বেসামরিক জনগণকে দেওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গত ২৫ আগস্টের এ সংক্রান্ত সরকারি আদেশে ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে গোলাবারুদসহ আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দিতে বলা হয়। এ ছাড়া এর আগে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে থানার লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়। নির্দিষ্ট তারিখের পরে কারও কাছে পুলিশের লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এর মাঝে কিছু অস্ত্র উদ্ধারও হয়েছে। তবে, এখনো অনেক আগ্নেয়াস্ত্র রয়ে গেছে বাইরে। যা যেকোনো সময় আইনশৃঙ্খলা অবনতির কারণ হতে পারে।

বর্তমানে দেশে কত বৈধ অস্ত্র আছে তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে পুলিশের শাখা (এসবি) থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, সারা দেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ৫০ হাজার ৩১০। এর মধ্যে ব্যক্তিগত অস্ত্র ৪৫ হাজার ২২৬টি। এর মধ্যে অস্ত্রের মধ্যে পিস্তল ৪ হাজার ৬৮৩টি, রিভলবার ২ হাজার ৪৩টি, একনলা বন্দুক ২০ হাজার ৮০৯টি, দোনলা বন্দুক ১০ হাজার ৭১৯টি, শর্টগান ৫ হাজার ৪৪৪টি, রাইফেল ১ হাজার ৭০৬টি এবং অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে ৪ হাজার ৬টি। বাকি অস্ত্রগুলো বিভিন্ন আর্থিক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নামে লাইসেন্স করা। প্রাপ্ত হিসাব বলছে, এসব অস্ত্রের মধ্যে ১০ হাজার ২১৫টি রয়েছে রাজনীতিবিদদের কাছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে রয়েছে ৭ হাজার ২১৫টি আগ্নেয়াস্ত্র। বিএনপির নেতাকর্মীর কাছে ২ হাজার ৫৮৭টি এবং অন্যান্য দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নামে ৭৯টি বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা ফয়সল হাসান জানান, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে যারা অস্ত্রের লাইসেন্স নিয়েছেন তাদেরকে ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে গোলাবারুদসহ আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দিতে হবে। ওদিকে এর আগে সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন সময় বৈধ অস্ত্র জমা নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। ওই সময় থানা ছাড়াও লাইসেন্সধারী বন্দুক ব্যবসায়ীরা বৈধ অস্ত্র জমা নেওয়া ও সংরক্ষণ করতে পারতেন। কিন্তু এবার প্রথম প্রজ্ঞাপনে সে ধরনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।

এদিকে পুলিশের লুণ্ঠিত অবশিষ্ট অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর কোনো ব্যক্তির কাছে পুলিশের লুণ্ঠিত কোনো ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ রক্ষিত থাকলে আগামী ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নিকটস্থ থানায় জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে। আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত এবং ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জমা দেওয়ার নির্দেশের পর অনেকেই সংশ্লিষ্ট থানায় যোগাযোগ করছেন। কীভাবে অস্ত্র জমা দিবেন সে বিষয়ে জানতে চাইছেন। অনেক থানার নথি পুড়ে যাওয়ায় অস্ত্রের লাইসেন্সধারীদের তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

কদমতলী থানার ওসি মাহমুদুর রহমান বলেন, থানার নথি পুড়ে যাওয়ায় কদমতলী এলাকায় লাইসেন্সপ্রাপ্তদের তথ্য আমাদের কাছে নেই। এ তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে যারা অস্ত্র জমা দিচ্ছেন তাদের অস্ত্র জমা রাখা হচ্ছে।  শ্যামপুর থানার ওসি শফিকুল ইসলাম বলেন, গত কয়েকদিন ধরে অস্ত্র জমা নেওয়ার কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু হয়েছে। তবে কতটা অস্ত্র জামা পড়েছে এ বিষয়ে কিছু জানাতে পারেননি তিনি।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদের শাসনামলে বিভিন্ন সময় বৈধ অস্ত্রের মারাত্মক অবৈধ ব্যবহারের ঘটনা ঘটে। রাজনৈতিক কর্মসূচি ও প্রতিপক্ষকে ভয় দেখাতে আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থকেরা বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন করেন। কখনো কখনো অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে পরে সেটিকে বৈধ অস্ত্র বলে দাবির ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনায় বেশির ভাগ সময়ে জেলা প্রশাসন ও পুলিশকে নিশ্চুপ ভূমিকায় থাকতে দেখা গেছে। এছাড়া গত ৫ আগস্ট ও পূর্ববর্তী সময়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বৈধ অস্ত্র নিয়ে মহড়া ও প্রকাশ্যে গুলি করতে দেখা যায়। ‘আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা-২০১৬’ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি নিজের লাইসেন্সের বিপরীতে নেওয়া অস্ত্র শুধু আত্মরক্ষার জন্য বহন ও ব্যবহার করতে পারবেন। অন্যের ভীতি বা বিরক্তি তৈরি হতে পারে, এমন ক্ষেত্রে অস্ত্র প্রদর্শন করা যাবে না। এটা করলে তার অস্ত্রের লাইসেন্স তাৎক্ষণিকভাবে বাতিলযোগ্য হবে।