বঙ্গোপসাগরে গত মাসের মাসের শেষদিকে একটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। কিন্ত শেষ পর্যন্ত সেটি ঘূর্ণিঝড়ের কাছাকাছি পৌঁছেও তা ঘটেনি। তবে এবার আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী অক্টোবর মাসে আবার ঘূর্ণিঝড় তৈরির আশঙ্কা রয়েছে। আর তেমনটি ঘটলে ঘূর্ণিঝড়টির নাম হবে ‘শক্তি’।
জানতে চাইলে আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক রোববার (২২ জুন) রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আগামী জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত সাগরে ঘূর্ণিঝড়ের কোনো আশঙ্কা নেই। তবে অক্টোবর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা রয়েছে।’
আবহাওয়াবিদদের মতে, এ অঞ্চলে মূলত বছরের দুটি সময় সাধারণত ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে। এর একটি সময় এপ্রিল থেকে মে মাস। আর অন্যটি অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাস। দক্ষিণ এশিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি থাকে বেশি। তবে নভেম্বর মাসেও বড় ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি থাকে। যেমন সিডর ঘটেছিল নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে।
জুন, জুলাই ও আগস্টে কেন ঘূর্ণিঝড় হয় না?
গ্লোবাল ক্লাইমেট মডেল অনুযায়ী, গত এপ্রিল ও মে মাসে একাধিক ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কার কথা বলা হয়েছিল। বিশেষ করে মে মাসের শুরুর দিকে বাংলাদেশের আবহাওয়া অবজারবেশন টিম (বিডব্লিউওটি) জানিয়েছিল, ওই মাসের মাঝামাঝি থেকে বঙ্গোপসাগরে একটি সার্কুলেশন সৃষ্টির কথা।
যেটি ধাপে ধাপে ঘূর্ণিঝড় তথা ‘শক্তিতে’ রূপ পাওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে সার্কুলেশন তৈরি হওয়ার পর সেভাবে এগোচ্ছিলও। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বের ধাপ গভীর নিম্নচাপও তৈরি হয়েছিল।
সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার থেকে দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। শক্তি সঞ্চয় করে ৬২ কিলোমিটারের ওপরে বাতাসের গতিবেগ উঠলেই সেটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ পেত।
ঠিক তখনই (২৯ মে) আবহাওয়াবিদ শাহানাজ সুলতানা রূপালী বাংলাদেশকে জানিয়েছিলেন, ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার ‘আর কোনো শঙ্কা নেই’। কারণ সেটি স্থলভাগে প্রবেশ শুরু করায় ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে শক্তি সঞ্চয় করার সুযোগ নেই। ফলে সে যাত্রায় ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তির’ আশঙ্কাও কেটে যায়। এরপর আর ঘূর্ণিঝড়ের কোনো পূর্বাভাসও আসেনি।
আবহাওয়াবিদ নাজমুল হক বলেন, ‘বছরের প্রথম ধাপে এপ্রিল ও মে মাসে ঘূর্ণিঝড় তৈরির টেম্পারেচার (তাপমাত্রা) থাকে। ফলে ওই সময় শেষ হলে ঝূর্ণিঝড়ের আশঙ্কাও শেষ হয়ে যায়। কারণ জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে ঘূর্ণিঝড় তৈরির টেম্পারেচার থাকে না। এই সময়ে বড়জোড় মৌসুমী নিম্নচাপ তৈরি হয়। তবে এখন দ্বিতীয় ধাপে কী ঘটে সেটিই আশঙ্কার বিষয়।’
অক্টোবর-নভেম্বর কেন ঘূর্ণিঝড়ের জন্য শঙ্কার?
আবহাওয়া অধিদপ্তরের দীর্ঘমেয়াদী (ত্রৈমাসিক) প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি জুন মাস এবং পরবর্তী জুলাই ও আগস্ট মাসে সাগরে ৩ থেকে ৪ টি লঘুচাপ তৈরি হতে পারে।
অধিদপ্তরের পরিচালক ও বিশেষজ্ঞ কমিটির চেয়ারম্যান মো. মমিনুল ইসলামের দেওয়া প্রতিবেদনেও বলা হয়, ওই তিন মাসে ‘২ থেকে ৩টি মৌসুমী নিম্নচাপে’ পরিণত হতে পারে। অর্থাৎ এ সময়ে আর কোনো ঘূর্ণিঝড়ের ‘আশঙ্কা নেই’।
তবে আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা রয়েছে। কারণ তখন ঘূর্ণিঝড়ের প্রয়োজনীয় সব প্যারামিটার উপস্থিত থাকে।’
‘আমরা মূলত গ্লোবাল ক্লাইমেট মডেলের ভিত্তিতে ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দিয়ে থাকি। সে অনুযায়ী মাসিক ও ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন প্রকাশ করি। কিন্তু তাদের (গ্লোবাল ক্লাইমেট মডেল) আপডেট এখনো আসেনি। সামনের মাসে আপডেট পাব। তখন আমরাও দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাস দেবো।’
পরবর্তী ঘূর্ণিঝড় কতটা শক্তিশালী হতে পারে?
এ যাবৎ বেশ কিছু শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আঘাত আনে উপকূলে। এর মধ্যে সবচেয়ে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় ছিল সিডর। স্মরণকালের ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়টি ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল।
আঘাতের সময় সিডরের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার। যেটি দমকা হাওয়ার বেগ উঠছিল ঘণ্টায় ৩০৫ কিলোমিটার পর্যন্ত। যার প্রভাবে উপকূলে ১৫ থেকে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। সেই আঘাত, প্রাণহানি, ক্ষয়ক্ষতির দুঃসহ স্মৃতি আজও ভুলতে পারেনি উপকূলের মানুষ।
তবে সাম্প্রতিক বছরের প্রথম ধাপেও আম্ফান ও রিমালের মতো বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ও আঘাত এনেছে। ফলে দ্বিতীয় ধাপে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হলে সেটি কেমন হতে পারে- এটিই এখন প্রশ্ন।
পরবর্তী ঘূর্ণিঝড় কেমন শক্তিশালী হতে পারে, এমন বিষয়ে আবহাওয়াবিদ নাজমুল হক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা মূলত গ্লোবাল ক্লাইমেট মডেলের ভিত্তিতে একটা দীর্ঘমেয়াদী পূবার্ভাস দেই। এটি একটি ধারণা মাত্র।’
‘তবে ঘূর্ণিঝড়টি কেমন হবে, তা তখনকার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে ৭-৮ দিন আগে বলা যায় যে, ঘূর্ণিঝড় কতটা শক্তিশালী হতে যাচ্ছে। তবে তার আগে ভালোভাবে বোঝা যায় না। তবে এখন এটুকু বলা যায়, অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা রয়েছে’, যোগ করেন এই আবহাওয়াবিদ।
ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’র নাম এলো কীভাবে?
সাগরে সার্কুলেশন তৈরি হওয়ার পর ধাপে ধাপে বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার হলে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ পায়। আর সেটি একটি নামে চিহ্নিত করা হয়। মূলত সচেতনতা, প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনার জন্যই এই নামকরণ হয়। বিশেষ করে গবেষণা কাজেও নামকরণ বেশ কাজে দেয়।
এ অঞ্চলের দেশগুলোর পক্ষ থেকে দেওয়া প্রস্তাবিত নাম থেকে পর্যায়ক্রমিক নামকরণ চূড়ান্ত করে আঞ্চলিক বিশেষায়িত আবহাওয়া দপ্তর (আরএসএমসি), ট্রপিক্যাল সাইক্লোন ওয়ার্নিং সিস্টেমস (টিসিডব্লিউএস) ও ভারতের আবহাওয়া দপ্তর (আইএমডি)।
সবশেষ ২০২০ সালে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ওমান, ইরান, সৌদি আরব, ইয়েমেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারের পক্ষ থেকে দেওয়া প্রস্তাবিত নামগুলোর তালিকা চূড়ান্ত হয়েছিল।
এরমধ্যে ৭টি দেশের দেওয়া নামে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হয়েছে। তালিকায় এখন পরবর্তী নাম রয়েছে- শক্তি (শ্রীলঙ্কা), মন্থ (থাইল্যান্ড), সেনিয়ার (সংযুক্ত আরব আমিরাত) ও দিত্ত্ব (ইয়েমেন)। ফলে এই অঞ্চলে নতুন যে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হবে সেটির নামকরণ হবে ‘শক্তি’।