দেশে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। সব সিটি করপোরেশন এলাকায় এখন প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্তের রোগী পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে ডেঙ্গুর থাবা বেশি বরিশাল সিটিতে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, বিগত বছরের তুলনায় এবার আক্রান্তে সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আক্রান্তের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে সেটি অভ্যাহত থাকলে সামনে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে ডেঙ্গু। কিটতত্ত্ববিদরাও বলছেন, ডেঙ্গুর ভয়াবহতা রোধে মশা নির্মূলের বিকল্প নেই।
মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী এখন বছরজুড়েই কমবেশি পাওয়া যাচ্ছে। তবে ডেঙ্গুর পিক সিজন মূলত আগস্ট থেকে অক্টোবর। ওই সময় এডিশ মশা বংশবিস্তারে সহায়ক আবহাওয়া তথা বৃষ্টিপাত ঘটে। ফলে সে সময় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে সামনে ভয়াবহ আকার ধারণ করার আশঙ্কা রয়েছে।’
ডেঙ্গু নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার। তার নেতৃত্বে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় ডেঙ্গুর ঘনত্ব নিয়ে গবেষণা হচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় চলতি বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি ‘সবচেয়ে বেশি’ খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
‘আমরা দেখেছি গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এ বছর মশার ঘনত্ব বেশি। আবার এ বছর রোগীও বেশি। এ থেকে মনে হচ্ছে এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি আগের তুলনায় বেশি খারাপ হওয়ার ঝুঁকি আছে।’
গত বছরের তুলনায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি
সারাদেশ থেকে প্রাপ্ত ডেঙ্গু রোগীদের তথ্য নিয়ে পরিসংখ্যান তৈরি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সরকারি সংস্থাটির হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পরিসংখ্যানটি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারির শুরু থেকে আজ শুক্রবার ( ২০ জুন) পর্যন্ত সবমিলিয়ে ৭ হাজার ৭৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে পুরুষ ৪১৯৩ জন ও নারী ২৮৮৩ জন।
আর গত বছরের একই সময়ে ছিল ৩ হাজার ৩০৪ জন রোগী। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় চলতি বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দ্বিগুনের বেশি।

তবে গতবছর এই সময়ে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৪১ জন। আর চলতি বছর এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৩০ জন। মৃত্যুর হার কম থাকলেও বিষয়টি গুরুত্ববহ নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হলে সেখানে মৃত্যুর ঝুকিও বেশি থাকে। ফলে আসন্ন পিক সময়ে রোগী বেশি হলে মৃত্যুর হার বেড়ে যেতে পারে।
ডেঙ্গু বাড়ছে জ্যামিতিক হারে
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১১৫১ জন রোগী। তবে এরপর কয়েক মাস ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমে আসে।
কন্ট্রোল রুমের তথ্য বলছে, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪, মার্চে ৩৩৬, এপ্রিলে ৭০১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন।
তবে এরপরই হঠাৎ বেড়ে গেছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। মে মাসে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৭৭৩ জন।

আর চলতি জুন মাসের শুরু থেকে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। গত ২০ দিনে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ৭৩০ জন।
এরমধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৫১ জন রোগী।
ডেঙ্গুর ‘হটস্পট’ বরিশাল
বিগত বছরগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ঢাকায় বেশি দেখা গিয়েছিল। কিন্তু এবার ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে।
চলতি বছরে যত জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তাদের অর্ধেকই বরিশালের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ৭ হাজার ৭৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মধ্যে বরিশাল বিভাগেই ৩ হাজার ২৮০ জন।
সেখানে গত বছরের এই সময়ে ছিল মাত্র ৪৫৯ জন ডেঙ্গু রোগী।
ডেঙ্গুর ঢাকার পরিস্থিতি কেমন
গতবছর এই সময় পর্যন্ত যতজন ডেঙ্গু রোগী আক্রান্ত হয়েছে, তার প্রায় অর্ধেকই ছিল ঢাকা বিভাগের। মোট ৩ হাজার ৩০৪ জন রোগীর মধ্যে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনসহ ঢাকা বিভাগে ১ হাজার ৫৯৯ জন ছিল ডেঙ্গু রোগী।
তবে এবার সে তুলনায় কিছুটা কম।
এবছর জানুয়ারির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনসহ ঢাকা বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে রোগী ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ২৬২ জন।
এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। সেখানে রোগীর সংখ্যা ১০০৭ জন।
আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে রোগী পাওয়া গেছে ৫৭৮ জন।
দুই সিটির বাইরে ঢাকা বিভাগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৬৭৭ জন।
ডেঙ্গু রোগী কম সিলেটে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, বর্তমানে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগ।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকা ও বরিশালের বাইরে জানুয়ারি শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন বেশি চট্টগ্রাম বিভাগে। সেখানে ১ হাজার ৩৪ জন রোগী আক্রান্ত হোন।
এছাড়া খুলনা বিভাগে ২০৩ জন, রাজশাহী বিভাগে ১৪২ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১১০ জন, রংপুর বিভাগে ২৫ জন ও সিলেট বিভাগে ২১ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
রাজধানীতে ডেঙ্গু মৃত্যু বেশি
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৩০ জন মারা গেছেন।
এরমধ্যে বিভাগীয় শহর ও সিটির মধ্যে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে সবচেয়ে বেশি রাজধানী ঢাকাতে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে বরিশাল বিভাগে ৭ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৩ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১ জন, ঢাকা উত্তর সিটিতে ১ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ১৫ জন, খুলনা বিভাগে ২ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ১ জন।
তবে একই সময়ে রাজশাহী, রংপুর এবং সিলেট বিভাগে ডেঙ্গুতে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১০, ফেব্রুয়ারিতে ৩, এপ্রিলে ৭, মে ৩ এবং জুন মাসে ৭ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
চলতি বছরের মার্চ মাসে ডেঙ্গুতে কারো মৃত্যু হয়নি। মৃতদের মধ্যে পুরুষ ১৬ জন এবং নারী ১৪ জন।
এরআগে ২০২৪ সালে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ৫৭৫ জনের এবং আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন।
২০২৩ সালে সারা দেশে ডেঙ্গুতে ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। ওই বছর হাসপাতালে ভর্তি হন তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গু রোগী।