ঢাকা মঙ্গলবার, ০১ জুলাই, ২০২৫

নির্বাচন প্রশ্নে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়াচ্ছে ‘পিআর’

মোস্তাফিজুর রহমান
প্রকাশিত: জুন ৩০, ২০২৫, ১১:২২ পিএম
বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন ও গণঅধিকার পরিষদের লোগো। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ গ্রাফিক্স

রাজনীতিতে এখন মুখ্য বির্তক হয়ে দাঁড়িয়েছে আনুপাতিক বা সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন (প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন- পিআর) ব্যবস্থা। এই পদ্ধতির প্রবর্তন নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। দলগুলোর নেতাদের পদ্ধতিটির পক্ষ-বিপক্ষের বক্তব্য উত্তাপ ছড়াচ্ছে। ফলে এই ইস্যুতে দলগুলোর মতবিরোধও এখন তুঙ্গে।

দেশের অন্যতম বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপি সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে কড়া বিরোধিতা করছে। তবে জামায়াতে ইসলামীসহ বেশকিছু রাজনৈতিক দল এই পদ্ধতির পক্ষে কঠোর অবস্থানের কথা জানাচ্ছে।

ঐকমত্য কমিশনের বক্তব্যও এসেছে, পিআর পদ্ধতি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতামত রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাজনীতির অঙ্গনে এক ধরনের ‘জটিলতার’ দিকে গড়াচ্ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সনাতন অথবা পিআর পদ্ধতিতে দলগুলোকে একমত করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ বিষয়ে ঐকমত্য না হলে আগামী নির্বাচন পিছিয়েও যেতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘দেশের বড় দল বিএনপি। তারা পিআর পদ্ধতির বিপক্ষে। এখন তারা যদি এটি না চায় তবে এই পদ্ধতি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আবার যদি পিআর পক্ষের দলগুলো অনঢ় অবস্থানেই থাকে। তবে দলগুলোকে ঐকমত্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এতে নির্বাচন পিছিয়েও যেতে পারে।’

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরই রাজনৈতিক অঙ্গনে নির্বাচনী কাঠামো নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।

পরে সংস্কারের লক্ষ্যে ১১টি কমিশন গঠন এবং ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়। সেখানে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতি নিয়ে প্রস্তাব আসে।

পিআর পদ্ধতির বিপক্ষে কড়া অবস্থান বিএনপির, একই সুরে মিত্রদের তৎপর করতে তৎপরতা

সনাতন পদ্ধতিতেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায় বিএনপি। তবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিপক্ষে দলটি। শুধু বিপক্ষেই নয়, পিআর ইস্যুতে মিত্রদের ঐক্যবদ্ধ করছে দলটি।

বিএনপির ভাষ্য, দেশের প্রেক্ষাপটে পিআর পদ্ধতি উপযুক্ত নয়। তা ছাড়া এই পদ্ধতি অনেক জটিল অবস্থা তৈরি করবে।

জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ নিয়ে সম্প্রতি সরকারের সঙ্গে বিরোধে জড়ায় বিএনপি। তবে সম্প্রতি লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক হলে সেটি নিরসন হয়। তবে এরপরই পিআর ইস্যু সামনে আসে।

বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, দলীয় ফোরামে এখন অন্যতম আলোচ্য বিষয় পিআর ইস্যু। যেখানে উঠে এসেছে, পিআর পদ্ধতি সামনে আনার অন্যতম কারণ নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া।

নেতাদের ভাষ্য, তারা যেমন এই পদ্ধতিতে একমত হবে না। তেমনি পিআর পদ্ধতি পক্ষে কিছু দলকে রেখে ঐকমত্যের জটিলতা তৈরি হচ্ছে। একে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবেও দেখছেন দলের নীতিনির্ধারকরা।

পিআর পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা শুরু হলে তখনই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘সংখ্যানুপাতিক হারে (পিআর)  নির্বাচন পদ্ধতি দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে ‘জুতসই নয়’। এ ধরনের নির্বাচনপদ্ধতি একটি সরকারের স্থিতিশীলতার ‘পরিপন্থি’।

বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস রোববার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আনুপাতিক হারে ভোট এবং আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের যারা দাবি তুলছে, তারা দেশ-জাতির সর্বনাশ করতে চাচ্ছে। একেকজন একেকটা দাবি তুলে নির্বাচনকে পিছিয়ে দিতে চাচ্ছে।’

 

এদিকে স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডাকে বিএনপি। সোমবার (৩০ জুন) রাত সাড়ে ৮টায় গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এই বৈঠক হওয়ার কথা। বিএনপি’র নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, বৈঠকের মূল এজেন্ডা হচ্ছে সংস্কার ইস্যু।

একজন নেতা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বৈঠকে মূলত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলীয় নেতাদের পিআর ইস্যুতে দিকনির্দেশনা দেবেন।’

এদিকে, পিআর ইস্যুতে মিত্র দলগুলোর সঙ্গেও যোগাগোগ বাড়িয়েছে বিএনপি। গত শুক্রবারও ১২ দলীয় জোট নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেছে দলটি। সেখানে দলটির পক্ষ থেকে জোটের নেতাদের পিআর পদ্ধতির বিপক্ষে জোরালো অবস্থান নিতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকেও বিএনপির সুরে কথা বলতে অনুরোধ করা হয়েছে।

ওই বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে অংশ নিয়েছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। পরদিন শনিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘যারা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচনের কথা বলছেন, তাদের একটি উদ্দেশ্য আছে। যারা স্থানীয় সরকার নির্বাচন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে চান, তাদের একটি উদ্দেশ্য আছে। হয় নির্বাচন বিলম্বিত করা, না হয় বাংলাদেশে নির্বাচন না হওয়া।’

পিআর ইস্যুতে ‘এককাট্টা’ হচ্ছে জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলো

পিআর পদ্ধতিতে শুরু থেকে সরব বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তারা সনাতন পদ্ধতির বিপক্ষে। দলটি মনে করে, সনাতন পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে আবারও দেশে ‘ফ্যাসিবাদ’ তৈরি করবে। তবে পিআর পদ্ধতিতে গেলে আর ‘ফ্যাসিস্ট সরকার’ তৈরি হবে না।

তা ছাড়া দলটি এ-ও মনে করছে, আসন্ন নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে হলে জাতীয় সংসদে সবার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে। সেই সঙ্গে নিজেদের প্রতিনিধিত্বও বাড়বে। যেটি সনাতন পদ্ধতিতে হলে সম্ভব হবে না। আর এই পদ্ধতিতে হলে তাদের ছোট ছোট দলগুলোকেও টানতে সুবিধা হবে। যার ফলে পিআর পদ্ধতির পক্ষে শুরু থেকেই জোরালো বক্তব্য দিয়ে আসছেন জামায়াতের নেতারা।

জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান সম্প্রতি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘দেশে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল (পিআর) নির্বাচনব্যবস্থা চালুর পক্ষে আমরা জোরালো মতামত ব্যক্ত করেছি। বিশ্বাস করি, এ ব্যবস্থায় জনগণের মতামত সঠিকভাবে প্রতিফলিত হবে এবং ফ্যাসিবাদী শাসন পুনরায় ফিরে আসার পথও রুদ্ধ হবে।’

এদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ অন্যান্য ইসলামিক দলগুলোর সঙ্গেও ইস্যুতে ‘এককাট্টা’ হওয়ার আলোচনা চালাচ্ছে জামায়াত। জামায়াতের সঙ্গে মতবিরোধ থাকলেও ধারাবাহিক আলোচনায় এখন অনেকটাই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে ইসলামী আন্দোলন। ফলে এখন একই সুরে কথা বলছেন ইসলামী আন্দোলনের নেতারাও।

ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গত শনিবার (২৮ জুন) ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসমাবেশে অংশ নেয় জামায়াত। সেখানে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে না হলে দেশের জনগণ তা গ্রহণ করবে না। এ বিষয়ে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত ঐক্যের স্রোত তৈরি হয়েছে।’

 

সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, ‘বাংলাদেশে ইসলামপন্থিরাই হবে সবচেয়ে ‘বড় রাজনৈতিক শক্তি’।’

‘আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ করতে হবে। এটাই এখন জনগণের দাবি। যত ভোট, তত প্রতিনিধিত্ব, এই নীতি বাস্তবায়নের পক্ষে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল একমত। বিএনপিকেও এই পদ্ধতিতে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’

জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের একাধিক নেতা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, তারা পিআর পদ্ধতির নির্বাচন প্রবর্তনে সব দলকে ঐক্যবদ্ধ করছেন। এ ক্ষেত্রে ইসলামিক দলগুলোই নয়, অন্যান্য দলের সঙ্গেও সংযোগ বাড়িয়েছেন। একটি ঐক্যমতের ভিত্তিতে আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেবেন তারা।

এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদ পক্ষে, পিআর চায় বামরাও

৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সেই সংগঠন বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।

ওই আন্দোলনের অন্যতম র্শীষ নেতা নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বাধীন দলটিও সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের (পিআর) পক্ষে। একইভাবে ২০১৮ সালের প্রথম কোটা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূরের নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদও চায় পিআর পদ্ধতি। একই ব্যবস্থা চালুর দাবি করছে বামজোটও।

এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম শনিবার ঢাকায় এক সমাবেশে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আগামী নির্বাচন কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা দলকে সামনে রেখে পরিচালিত হবে না।’

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ভিপি নুরুল হক নূরও বিভিন্ন সময় সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছেন। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘সংসদে একটা ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা থাকতে হবে। যেই রাজনৈতিক দল জনগণের ভোট পাবে তারা যেন সংসদে থাকতে পারে। তার জন্য সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের একটা বিধান, অর্থাৎ কোনো দল যদি ১ পার্সেন্ট ভোট পায় সারা বাংলাদেশে, সেই দলের ৩ জন সংসদ সদস্য প্রার্থী থাকবে।’

‘কোনো ছোট দল যদি ১০ পার্সেন্ট ভোট পায়, যেহেতু ৩০০ আসন তার ৩০ জন এমপি থাকবে। তাহলে কোনো একক দলের মাতব্বরি সংসদে থাকবে না। অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনী ব্যবস্থা চায় আমাদের দল, জামায়াতসহ বিভিন্ন দল। একমাত্র বড় ২-১টা দল ব্যতীত সব দল এই সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে’, যোগ করেন নূর।

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের সংলাপের সপ্তম দিনের দ্বিতীয় পর্ব শেষে রোববার বামজোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘সংসদে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা চালু করতে পারলে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যেত এবং অর্থের প্রভাব কমানো সম্ভব হতো।’