কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। একজন ইউএস স্টেট সুসি গ্লোবাল স্কলার। তিনি মিডওয়েস্ট পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের (শিকাগো, যুক্তরাষ্ট্র) মেম্বার। সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির (বুদাপেস্ট, হাঙ্গেরী) স্কলারও তিনি। কাজ করেছেন ওয়াল্ড ব্যাংক, আইএমএফ, ডব্লিউটিও, ইইউ, সার্ক, আসিয়ানের বিভিন্ন গবেষণা কাজেও। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেছেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক। আলোচনার মূল বিষয় ছিল- আনুপাতিক বা সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা (পিআর)।
রূপালী বাংলাদেশ: রাজনীতি অঙ্গণে আনুপাতিক নির্বাচনী (পিআর) ব্যবস্থা নিয়ে এখন বেশ আলোচনা হচ্ছে। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বির্তক দেখা দিয়েছে। একটা বিভক্তিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই পদ্ধতিটি আসলে কি?
অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর: প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর), যাকে আমরা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর বলছি। এটা এমন একটি নির্বাচনী পদ্ধতি যেখানে সংসদের আসনবন্টন হয় রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। অর্থাৎ যে দল মোট ভোটের যত শতাংশ ভোট প্রাপ্ত হবে সে অনুযায়ী আসনও প্রাপ্ত হবে। এতে প্রত্যেকটি ভোটের প্রতিনিধিত্ব সংসদে নিশ্চিত হয়।
রূপালী বাংলাদেশ: আনুপাতিক নির্বাচনী বা পিআর ব্যবস্থা কি সব জায়গায় একই রকম। বিশ্বে এই পদ্ধতির ব্যবহারই বা কেমন?
অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর: পৃথিবীতে তিন ধরণের পিআর ব্যবস্থা চালু আছে। এরমধ্যে ৭০টি দেশে দলের ভিত্তিতে পিআর হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন রকমের পিআর আছে। এরমধ্যে আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতেও পিআর আছে, সেখানে দলের ভিত্তি হয় না, ভিন্ন একটা ভিত্তিতে পিআর হয়। মূলত সেসব দেশের রাজনৈতিক অবস্থা, ভৌগোলিক অবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর ভিত্তি করে পিআর ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে।
রূপালী বাংলাদেশ: বাংলাদেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী পদ্ধতি (পিআর) চালুর প্রস্তাব এসেছে। দলগুলোর মধ্যে এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দিচ্ছে। এ নিয়ে বেশ আলোচনাও হচ্ছে। এখানে এই পদ্ধতি চালু করা কতটা উপযুক্ত?
অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর: দেখুন, সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় পিআর থাকে বেশিরভাগ দেশে। আর সেখানে যেহেতু আঞ্চলিক দল থাকে, আবার অধিকাংশ দলেরই অনেক সময় অবস্থান থাকে না। তখন দেখা যায় যে, পিআর সিস্টেম হলে আঞ্চলিক দলগুলোর একটা ভিত্তি সংসদে নিশ্চিত হয়। যে কারণেই এটা (পিআর) তারা তৈরি করেছে, যেন আঞ্চলিক দলগুলোর অবস্থান রক্ষা করা যায়।
আবার দেখুন, বড় রাষ্ট্র ভারতও, তাদেরও অনেক রাজ্য। সেখানে আঞ্চলিক দল আছে। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারে আঞ্চলিক প্রতিনিধি দরকার হয়। ভারসাম্য রক্ষার জন্য তাদেরও পিআর পদ্ধতি গ্রহণ করতে হয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে (বাংলাদেশে) সেটি (পিআর) উপযুক্ত হবে না।
রূপালী বাংলাদেশ: কেন উপযুক্ত হবে না?
অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর: কারণ আমরা যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থায় না। আবার ভারতের অবস্থার মতোও না। আমাদের ছোট রাষ্ট্র। আমরা এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থার মধ্যে আছি। এখানে আঞ্চলিক রাজনীতি নাই। আঞ্চলিক কোন দলও নাই। তা ছাড়া অঞ্চলের প্রধিনিধিত্বহীনতার ভয় নাই- তাই বলা যায় এখানে পিআর ব্যবস্থা চালু যৌক্তিক হবে না।
রূপালী বাংলাদেশ: যদি পিআর ব্যবস্থা চালু হয় তবে সমস্যা কোথায়?
অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর: দেখুন, বাংলাদেশ ছোট দেশ। এতো ছুটো দেশ যে, এই দেশে পিআর সিস্টেম চালু করলে খরচ বেড়ে যাবে। ট্যাক্সের টাকার নতুন ব্যয় তৈরি হবে। আর উচ্চকক্ষে সবদেশেই প্রফেশনালিজম হয়, সেক্ষেত্রে এখানে উচ্চকক্ষে পিআর সম্ভব নয়।
আর পিআর করলে এই দেশে নিম্নকক্ষে সরকার গঠনই কঠিন হয়ে যাবে। দেশের প্রেক্ষাপটে নিম্নকক্ষে আনুপাতিক সিস্টেম যর্থাথ হবে না। কারণ এখানে এককভাবে কোন দল সরকার গঠনই করতে পারবে না। সরকার গঠনের যে সমর্থন লাগে, তখন যেখানে দেখা যাবে অন্য কারোর সমর্থন লাগছে।
রূপালী বাংলাদেশ: সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করলে সমস্যা কী?
অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর: আসলে ওই সমর্থনের জন্য কম্প্রোমাইজ (ছাড়) করতে হয়। এতে যারা সরকার গঠন করার সামর্থ্য রাখে তারা সমর্থন নিয়ে করতে গিয়ে দুর্বল হয়ে পড়বে। ছোট দলগুলোর গুরুত্ব বেড়ে যাবে। তখন ছোট দলগুলো বার্গিং (কষাকষি) করবে বেশি। এতে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন আরো বেড়ে যাবে।
আবার উচ্চকক্ষে একটা এমন বিভেদ তৈরি হবে যে, যা জাতিকে বিভক্ত করে ফেলবে। নিম্নকক্ষ উচ্চকক্ষ একমত হতে পারবে না অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে। তখন তো রাজনৈতি এক রকম গুরুত্বহীন হয়ে যেতে পারে। রাজনীতিবিদদের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আমরা রাজনৈতিবিদদের বা সরকারকে অথবা যারা ক্ষমতায় আসবে তাদের দুর্বল করে ফেলবো। আর দুর্বল সরকার দেশকে পরিচালনা করতে পারবে না।
রূপালী বাংলাদেশ: পিআরে খরচ বেড়ে যাওয়ার কথাও বলেছেন, এটি কিভাবে হবে?
অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর: পিআর চালু হলে খরচ তো অনেকভাবেই বাড়বে। দেখুন, আমাদের তো নিম্নকক্ষের তথা সংসদ সদস্যদেরই সুযোগ সুবিধা দিয়ে বাঁচি না। তা ছাড়া তাদের দুর্নীতি, তাদের দুর্বৃত্তায়ন, তাদের গোস্টি রক্ষা করে বাঁচি না। এখন আবার উচ্চকক্ষ তৈরি করলে আরেকটা অত্যাচারী মহল তৈরি হয় কিনা সেটিই বড় প্রশ্ন। নতুন সৃষ্ঠ গোষ্ঠি তৈরি হয়ে আবার মানুষদের ওপর নাগরিকদের ওপর অত্যচার শুরু করবে কিনা ভাবা দরকার।
রূপালী বাংলাদেশ: স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করতে পারলে কী পিআর পদ্ধতি কার্যকর হতো?
অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর: স্থানীয় সরকার না, আঞ্চলিক রাজনীতি শক্তিশালী হতে হবে। যেমন ভারত বড় দেশ। সেখানে আঞ্চলিক রাজনীতি আছে। ক্ষমতাসীন দল থেকে বিভিন্ন অঞ্চলে অন্য দল জনপ্রিয় বেশি। সেখানে আঞ্চলিক প্রতিনিধি দরকার হয়। কিন্তু আমাদের তো এগুলো লাগে না।
রূপালী বাংলাদেশ: যদি এতো সমস্যাই থাকে তাহলে কেন এমন প্রস্তাব উঠলো, অনেকেই বা কেন এটি চাচ্ছেন?
অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর: কেনো চায় সেই বক্তব্য তারাই দিক। তবে তাদের পিআর ব্যবস্থা তৈরি করার তাত্বিক ভিত্তি দাড় করাতে হবে।
রূপালী বাংলাদেশ: তাহলে দলগুলো কি তাত্বিক ভিত্তি ছাড়াই পিআর চাচ্ছে?
অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর: আসলে যারা পিআর চাচ্ছে তারা যতেষ্ট জাস্টিফাই করে নেননি। প্রস্তাব এই দেশে নতুন না। প্রস্তাব তো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও বাস্তবায়ন হয়েছে। যেখানে বাস্তবায়ন হয়েছে সেখানে সুফল কি ছিল বা কুফলই কি হয়েছিল- সে থেকে তারা কি শিক্ষা নিয়েছে সেগুলো যাচাই-বাচাই হয়নি। কারণ এখানে গবেষণালব্ধ থেকে এই আলোচনা আসছে না। জাস্ট কোনো কোনো দলের মনে হয়েছে আর প্রস্তাব করে বসছে। এটাই হলো এখানে সমস্যা।
রূপালী বাংলাদেশ: তাহলে আপনার কথায় যারা নতুন পদ্ধতির পক্ষে তারা সঠিক পন্থায় নেই?
অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর: হ্যাঁ, বাংলাদেশে বড় ক্রাইসিস হলো- এতো সংকটের সমাধানের প্রস্তাব আসতেছে, কিন্তু এটার যে একটা তাত্বিক ভিত্তি থাকা দরকার সেটা নিয়ে কেউ আলোচনা করছে না। যার ফলে ভারসম্যহীন সংস্কার আসতেছে। তবে আমি মনে করি, পিআর বিষয়ে বিএনপির অবস্থান যৌক্তিক। কারণ বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে পিআর কোনভাবেই সঠিক না।
রূপালী বাংলাদেশ: তাহলে এখন কি করা উঠিত?
অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর: আমি মনে করি, এ দেশে পিআর সিস্টেম চালু করা হয় তাহলে আরও হিসেব করা উচিত। এ বিষয়ে হোম ওয়ার্ক করা উচিত, অনেক বেশি বিচার বিশ্লেষণ করা উচিত। রাজনৈতিক দলগুলোকে আরও অনেক বেশি বসা উচিত। আলোচনা করা উচিত। এরসাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদেরও সম্পৃক্ত করা উচিত।
রূপালী বাংলাদেশ: এখন যদি সব দল ঐকমত্য হয় আর বিএনপি বিপক্ষে অনঢ় থাকে তবে কি এই পদ্ধতি চালু সম্ভব?
অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর: শুধু পিআর নয়, অনেক বিষয়ই আছে। সেসব বিষয়েও একমত হয়নি দলগুলো। এগুলো নিয়ে দলগুলো নিজেদের অবস্থানে অনঢ় থাকতে পারে। তবে বিএনপির অবস্থানটাকে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ অন্যান্য দলগুলো চাইলেও তাদের অবস্থানের বাইরে গিয়ে করাটা কঠিন হবে। আর বিএনপিকে যদি কনভেন্স করতে পারে তাহলে ভিন্ন কথা।
রূপালী বাংলাদেশ: জানতে পাচ্ছি আনুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থার পক্ষে জামায়তসহ বেশ কিছু দল এককাট্টা হচ্ছে, অন্যদিকে বিপক্ষে বিএনপিও মিত্রদের নিয়ে শক্ত অবস্থান নিচ্ছে। ফলে দুই পক্ষের বিভেদে কোন সংকট তৈরি হবে কিনা?
অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর: আমরা মনে হয়, সংকট তৈরি হবে না। কারণ ছোট ছোট দল যারা পিআর চাই তারা তো শক্তিশালী দল না। তারা দাবি করে যাবে হয়ত। শেষ পর্যন্ত দলগুলোর মধ্যে একটা সমঝোতা হবে। কারণ বিএনপি বড় দল, তারা যতদিন এটার পক্ষে না থাকে তাহলে এটা সম্ভব হবে না।
রূপালী বাংলাদেশ: তারপরও পিআরের পক্ষের দলগুলো শক্ত অবস্থান নিলে কী পরিস্থিতি দাঁড়াতে পারে?
অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর: অনেক বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছে, বাকী বিষয়গুলোতে একমত না হয় তাহলে আলোচনা থেমে থাকবে। নির্বাচন হতে সময় ক্ষেপণ হবে।
রূপালী বাংলাদেশ: আপনাকে ধন্যবাদ।
অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর: রূপালী বাংলাদেশকেও ধন্যবাদ।
আপনার মতামত লিখুন :