লর্ডসের কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় ২০০৫ সালের সেই সকালে লর্ডসের পোশাকি নীরবতা ভেঙে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছিল এক কিশোর—চোখে স্বপ্ন, মনে ভয়, আর বুকভরা উত্তেজনা। বয়স তখন মাত্র সাড়ে ১৬। নাম মুশফিকুর রহিম।
বাংলাদেশের ইতিহাসে তখন টেস্ট ক্রিকেট ছিল নতুন, শৈশবের মতোই অনভিজ্ঞ। আর সেই অনভিজ্ঞতার ভিড়ে দাঁড়িয়েই অভিষেক হলো ছোটখাটো গড়নের, কিন্তু কণ্ঠে অবিশ্বাস্য দৃঢ়তা নিয়ে আসা সেই ছেলেটির।
সেদিন হয়তো কেউ ভাবেনি, লর্ডসের সেই গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা কিশোর একদিন দেশের ক্রিকেটকে নিজের কাঁধে নিয়ে টেনে তুলবে বারবার। স্বপ্নটাকে এতদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে যে, দুই দশক পরে তার নাম লেখা হবে রেকর্ডের পাতায়—ইতিহাসের খুব কাছে।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের পঞ্চপাণ্ডবের অন্যতম ও নির্ভরতার প্রতীক মুশফিকুর রহিম। দুই দশকের বেশি সময় ধরে জাতীয় দলে দুর্দান্ত ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন ‘মি. ডিপেন্ডেবল’ নামে। ব্যাট হাতে দল সংকটে পড়লেই যার দিকে তাকিয়ে থাকে পুরো দেশ, সেই মুশফিক এবার গড়তে চলেছেন এক অনন্য মাইলফলক।
ইতোমধ্যে তিনি খেলেছেন ৯৯টি টেস্ট ম্যাচ। আগামীকাল বুধবার মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠে নামবেন তার ক্যারিয়ারের ১০০তম টেস্টে। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এই প্রথম কোনো ক্রিকেটার সেঞ্চুরি টেস্টে পা রাখতে যাচ্ছেন—যা নিঃসন্দেহে দেশের টেস্ট ইতিহাসের এক বড় অর্জন।
২০০৫ সালে লর্ডসে অভিষেক
মুশফিকের টেস্ট যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৫ সালে, ঐতিহাসিক লর্ডসের মাটিতে। মাত্র সাড়ে ১৬ বছর বয়সে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া এই ব্যাটার শুরু থেকেই সাহসী খেলার পরিচয় দেন।
অভিষেকের পর ধীরে ধীরে তিনি দলের সবচেয়ে বড় ভরসার নাম হয়ে উঠেন।
বর্ণিল টেস্ট ক্যারিয়ার ও রেকর্ড
টেস্ট ক্যারিয়ারে মুশফিক বরাবরই ছিলেন বড় ম্যাচের বড় খেলোয়াড়। তার উল্লেখযোগ্য সাফল্যগুলোর মধ্যে রয়েছে—
১ : বাংলাদেশের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির মালিক
২ : একমাত্র বাংলাদেশি, যার টেস্টে তিনটি ডাবল সেঞ্চুরি রয়েছে
৩ : পাঁচ ও ছয়ের পজিশনে নেমে ধারাবাহিকভাবে সর্বোচ্চ রান করার রেকর্ড
৪ : ৬,০০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করা দেশসেরা ব্যাটারদের একজন
৫ : উইকেটকিপার-ব্যাটার হিসেবে একাধিক ম্যাচ বাঁচানোর কৃতিত্বও রয়েছে তার ঝুলিতে
এ ছাড়াও দলের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তে, বিশেষ করে বিদেশের কন্ডিশনে, অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেছেন তিনি।
ঘরের মাঠে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ১০০তম টেস্ট
আগামীকাল ১৯ নভেম্বরের ম্যাচটি শুধু মুশফিকের ব্যক্তিগত মাইলফলক নয়, বরং দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দিন। কারণ এর আগে বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটার টেস্টে এত ম্যাচ খেলেননি।
মিরপুরের এই ম্যাচকে ঘিরে ক্রিকেট অঙ্গনে ইতোমধ্যে বিশেষ উত্তেজনা। বোর্ড থেকেও নেওয়া হয়েছে বিশেষ আয়োজনের প্রস্তুতি। অনেক ভক্তই মুশফিকের ১০০তম টেস্টে বিশেষ এক ইনিংস দেখার অপেক্ষায়।
দেশের ক্রিকেটে মুশফিকের অবদান
মুশফিক শুধু রান বা রেকর্ডের খেলোয়াড় নন, তিনি পুরো এক প্রজন্মের অনুপ্রেরণা। তার অবদান—
১ : বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটে স্থিতিশীলতা আনার অন্যতম কারিগর
২ : নেতৃত্বে দেশের হয়ে স্মরণীয় জয় এনে দেওয়া
৩ : তরুণ ক্রিকেটারদের মেন্টর হিসেবে বড় ভূমিকা
৪ : চাপের ভেতর লড়াই করার মানসিকতা দিয়ে দলের পরিচয় বদলে দেওয়া
ব্যাট হাতে মুশফিক দুই দশকের ক্যারিয়ারে ১১টি সেঞ্চুরি, ২৭টি ফিফটি এবং ৩টি ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন। মোট রান ৬,৩২৮ এবং ব্যাটিং গড় ৩৮.১২, যা তাকে দেশের টেস্ট ইতিহাসের অন্যতম সফল ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।




