ঢাকা রবিবার, ২৯ জুন, ২০২৫

খুলনায় বাড়ছে খুনখারাবি

হাসানুর রহমান তানজির, খুলনা
প্রকাশিত: জুন ২৯, ২০২৫, ০২:০০ এএম

আধিপত্য বিস্তার, মাদক বিক্রির পয়েন্ট দখল এবং নিজেদের দ্বন্দ্বের কারণে খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রেনেড বাবুর সাম্রাজ্যে দেখা দিয়েছে ভাঙন। বাবুর সদস্যরা এখন একে অপরের শত্রু। যে যখনই সুুযোগ পাচ্ছে অন্যজনকে হত্যা করছে। গত এক মাসে নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বে মৃত্যু হয়েছে গ্রেনেড বাবুর খুব কাছের দুই সদস্য। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে মাদক বিক্রির পয়েন্ট দখলকে কেন্দ্র করে বাবুর একান্ত সহযোগী সাব্বির খুন হয়। রাতের ঘটনায় নয়ন ও রফিক নামে আরও দুই যুবক নিখোঁজ রয়েছে। এসব ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রেনেড বাবু। গ্রেনেড বাবুর দল ‘বি’ কোম্পানি হিসেবে পরিচিত প্রশাসনের কাছে। এই দলের সদস্যরা খুন, আধিপত্য বিস্তার, মাদক বিক্রি, জমি দখল চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত। মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গত বৃহস্পতিবার বাবুর অনুসারিদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় কাউয়া মিরাজ, সাব্বির, সাদ্দামসহ মোট চারজন গুলিবিদ্ধ হয়। এর মধ্যে বাবুর একান্ত সহযোগী সাব্বির ও কাউয়া মিরাজ। এর মধ্যে সাব্বির মারা যায়। গুলিবিদ্ধ সাদ্দামকে খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতাল থেকে ঢাকায় রেফার্ড করা হয়েছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। গুলিবিদ্ধ মিরাজসহ আরেক সহযোগী খুলনা নার্গিস মেমোরিয়াল হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে পুলিশ আসার আগে পালিয়ে যান বলে পুলিশ জানিয়েছে।

আরও জানা যায়, রূপসা রাজাপুর পাট গুদাম এলাকার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী নয়নের মাদক বিক্রির পয়েন্ট নিয়ে মূল সংঘাতের সূত্রপাত সোহাগের বাসায়। সাব্বির নাকি মিরাj কার মাল বিক্রি করবে নয়ন এ নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে। এ ছাড়া জোয়ার বাদাল এলাকার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী বোরহান। সেও সাব্বির ও মিরাজের সাপোর্টে মাদক ব্যবসা করে আসছে।


গত বৃহস্পতিবার রাতে রূপসা থানাধীন আইচঘাতী ইউনিয়নের রাজাপুর এলাকায় শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী সোহাগের বাড়িতে এই গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থল থেকে ছয়টি খালি কার্টিজ, চারটি লাইভ কার্টিজ, ইয়াবা এবং মাদক সেবনের সরঞ্জাম উদ্ধার করে পুুলিশ।


এর আগে ২৫ মে রাতে রূপসা উপজেলার মোছাব্বরপুর গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ার হাওলাদারের ছেলে রনিকে মোবাইল ফোনে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। রনি বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর কয়েকটি গুলির শব্দ হয়। পরবর্তীতে পরিবারের সদস্যরা বাইরে গিয়ে রনির নিথর দেহ মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। রনি ছিল গ্রেনেড বাবুর একান্ত সহযোগী। মাদক ব্যবসার টাকা ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে নিজেদের বাহিনী সদস্যের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে সেদিন তাকে মরতে হয়।


নগরীর নার্গিস মেমোরিয়াল হাসপাতালের সহকারী ম্যানেজার মো. শহিদুল্লাহ শাহিদ জানান, বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে দুইজন ব্যক্তি ইনজুরি অবস্থায় আমাদের হাসপাতালে আসেন। তাদের শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল। যেহেতু পুলিশ কেস যার কারণে আমরা তাদের রাখিনি। প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পরপরই তারা দ্রুত চলে যায়। সাদ্দামের ভাই জুয়েল জানান, তার ভাইয়ের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এখনো তার জ্ঞান ফেরেনি।


পুলিশ ও একাধিক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০০১ সালে বোমা তৈরি করে চরমপন্থিদের কাছে সাপ্লাই দিয়ে এবং নাশকতার সঙ্গে জড়িত থাকায় পুলিশ-র‌্যাব’র শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় উঠে আসে গ্রেনেড বাবু। এরপর মাদক বিক্রি, চাঁদাবাজি ও জুয়ার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ন্ত্রণ করতে গ্রেনেড বাবু নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলে। ২০১০ সালের ১০ জুন সন্ধ্যায় ট্যাংক রোডের বাসিন্দা হাকিম মো. ইলিয়াস হোসেনের ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন কচিকে হত্যা করে গ্রেনেড বাবু ও তার সহযোগীরা। এ মামলায় বাবুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ২০২৩ সালের ২৭ মার্চ এ হত্যা মামলায় আসামি রনি চৌধুরী ওরফে বাবু ওরফে গ্রেনেড বাবুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। একইসঙ্গে তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন।


খুলনার একাধিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রমতে, শহরে দীর্ঘদিন ধরে ত্রাসের রাজত্ব চালাচ্ছে গ্রেনেড বাবুর গ্রুপ। ওই গ্রুপের নেতৃত্বে ছিল রনি, সাব্বির ও মিরাজ। সম্প্রতি রনি ও সাব্বির খুন হন। আর তার গ্রুপে অস্ত্রধারী সদস্য রয়েছে আরও চারজন। তাদের নামে মোট মামলা রয়েছে ৩৩টি। গ্রেনেড বাবু গ্রুপের অস্ত্রধারী সদস্য মো. শাকিল, মো. সাব্বির শেখ, কাউয়া মিরাজ, আসাদুজ্জামান রাজু ওরফে বিল রাজু ও বিকুল যাদের কয়েকজনের নামে তিনটি করে মামলা রয়েছে। একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রেনেড বাবু বর্তমানে পলাতক। তবে তার মাদকের ব্যবসা খুলনাতে সক্রিয় রয়েছে।


নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক শেখ পাড়া এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানান, গ্রেনেড বাবু অনেক বড় মাপের মাদক ব্যবসায়ী। শেখ পাড়া এলাকার একটা পয়েন্টেই পাঁচ হাজার পিচের বেশি ইয়াবা বিক্রি হয় প্রতি সপ্তাহে। তাহলে বোঝেন সারা খুলনায় তার সব পয়েন্ট মিলে কত ইয়াবা বিক্রি হয়। আমি আজ পর্যন্ত শুনি নাই গ্রেনেড বাবুর মাল ধরা পড়ছে।


রূপসা রাজাপুর পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ মো. আশরাফুল আলম বলেন, সাব্বির খুলনা শহরের ছেলে হলেও আইচগাতি এবং রাজাপুর এলাকায় তার ব্যাপক প্রভাব ছিল। তার মুখের ওপর কথা বলার মতো সাহস কারো ছিল না। সাব্বির রনি হত্যা মামলার দুই নম্বর আসামি। এ মামলার তিন নম্বর আসামি কাউয়া মিরাজ। বৃহস্পতিবার রাতে তার পায়েও গুলি লাগে। খুলনা নার্গিস মেমোরিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর কাউয়া মিরাজ পালিয়ে যায়।


রূপসা থানার ওসি মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, এলাকার আধিপত্য বিস্তার এবং মাদক বিক্রির পয়েন্ট ও টাকা ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে সংঘঠিত হচ্ছে এসব হত্যাকাণ্ড। গ্রেনেড বাবুর সাম্রাজ্যে এখন ভাঙন দেখা যাচ্ছে। আমাদের কিছু করতে হচ্ছে না, তারা নিজেরা নিজেদের টার্গেট করে খুন করছে। তিনি আরও বলেন, সাদ্দামের ব্যাপারে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে খোঁজ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেখান থেকে কোনো তথ্য আমাদের জানানো হয়নি।


খুলনা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) মো. আনিসুজ্জামান জানান, গত মাসে রূপসায় কালা রনি নামের এক সন্ত্রাসীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনার প্রধান সন্দেহভাজন ছিলেন সাব্বির। তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। হামলাকারী ও শিকার দুই গ্রুপই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।