ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) সূত্রে জানা গেছে, গত ২২ এপ্রিল দক্ষিণ কাশ্মীরের পর্যটনস্থল পাহালগামে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক সন্ত্রাসী হামলায় জড়িত চারজন সন্ত্রাসী এখনও ওই অঞ্চলে লুকিয়ে আছে। তবে, ভারতীয় সেনাবাহিনী ও স্থানীয় পুলিশের ব্যাপক তল্লাশির মধ্যেও তারা ধরা পড়েনি এখনও।
সূত্র জানিয়েছে, এই সন্ত্রাসীরা আত্মনির্ভরশীল। অর্থাৎ, তারা নিজেরাই খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় রসদ বহন করে নিয়ে গেছে, ফলে জঙ্গলে দীর্ঘ সময় ধরে লুকিয়ে থাকতে পারছে এবং নজরদারি এড়িয়ে থাকতে পারছে।
এ অবস্থায় পাকিস্তান থেকে কোনও বাহ্যিক সাহায্যের প্রয়োজন পড়েনি তাদের। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করাও হয়েছে।
এ হামলাটি ছিল সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলাগুলোর একটি। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুলওয়ামায় ৪০ জন ভারতীয় জওয়ান নিহত হওয়ার পর এটিই সবচেয়ে বড় হামলা। এই ঘটনার তদন্ত বর্তমানে এনআইএর হাতে রয়েছে।
প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, পাহালগামের কাছাকাছি বৈসরান উপত্যকায় হামলার ৪৮ ঘণ্টা আগেই সন্ত্রাসীরা উপস্থিত ছিল। এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটনস্থল এবং একই জায়গায় হামলাটি সংঘটিত হয়।
আটককৃত ও জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, সন্ত্রাসীদের সমর্থক বা সহকারী ওভারগ্রাউন্ড কর্মীরা জানিয়েছে, তারা আরও চারটি জায়গা পর্যবেক্ষণ করেছিল- এর মধ্যে ছিল আরু ও বেতাব উপত্যকা। কিন্তু সেগুলি অতিরিক্ত নিরাপত্তার আওতায় থাকায় তারা তুলনামূলকভাবে কম রক্ষিত বৈসরানকে হামলার জন্য বেছে নেয়।
এই নিয়ে বিরোধী পক্ষ প্রশ্ন তুলেছে, এত বড় পর্যটন কেন্দ্রে সেনা বা আধাসামরিক বাহিনীর উপস্থিতি কেন ছিল না?
গোয়েন্দা সূত্রে আরও জানা গেছে, সন্ত্রাসীদের কাছে ছিল উন্নত প্রযুক্তির যোগাযোগ যন্ত্র। এই যন্ত্রগুলিতে সিম কার্ডের প্রয়োজন হয় না এবং সেগুলি স্বল্প পরিসরে এনক্রিপ্টেড বার্তা পাঠাতে সক্ষম, যা গোয়েন্দা সংস্থার জন্য সনাক্ত করা অত্যন্ত কঠিন।
তারা সম্ভবত তিনটি স্যাটেলাইট ফোন ব্যবহার করেছে, যাতে নিজেদের অবস্থান গোপন রাখা যায় এবং নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে বিভ্রান্ত রাখা যায়। হামলাটি শুরু হয়েছিল দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে।
হামলার পরিকল্পনা ছিল সরল: তিনজন সন্ত্রাসী গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে পর্যটকদের উপর গুলি চালায় এবং চতুর্থজন পিছনে থেকে সহায়তা করছিল।
হামলার পর দেখা যায়, কিছু লোককে ধর্মীয় প্রশ্ন করা হয়েছিল – মূলত ইসলামিক আয়াত আবৃত্তি করতে বলা হয়। যারা তা পারছিল না, তাদের কাছ থেকে অতি সামান্য দূরত্বে গুলি করে হত্যা করা হয়।
হামলার বিভীষিকাময় চিত্রগুলো অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে। এক ভিডিওতে দেখা যায়, এক নারী তার স্বামীর রক্তমাখা মুখ চেপে ধরে কাঁদছেন। অন্য একটি দৃশ্যে, এক সন্ত্রাসী এক নারীকে বলে, ‘গিয়ে (প্রধানমন্ত্রী) মোদীকে বলো’, তার স্বামীকে হত্যা করার পর।
নিহত ২৬ জন পুরুষের মধ্যে একজন নেপালি নাগরিক ছিলেন, একজন ছিলেন ভারতীয় নৌবাহিনীর কর্মকর্তা যিনি মাত্র এক সপ্তাহ আগে বিয়ে করেছিলেন এবং হানিমুনে গিয়েছিলেন।

আরেকজন ছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশের ৭০ বছরের বৃদ্ধ, এবং একজন কর্ণাটকের ৩৫ বছর বয়সি ব্যক্তি যিনি প্রাণ ভিক্ষা করেও রেহাই পাননি।
এই বর্বরোচিত হামলার নিন্দা জানিয়েছে সারা বিশ্ব। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, শুধুমাত্র হামলাকারীদের নয়, যারা এই হামলার পরিকল্পনা করেছে, তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর প্রতিশোধ নেওয়া হবে। তিনি বলেন, “সন্ত্রাসবাদের জঘন্য অভিসন্ধি সফল হতে দেওয়া হবে না।” একইসঙ্গে পাকিস্তান ও তার মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্ককে সতর্ক করেন।
ভারতের প্রতিক্রিয়া ছিল কূটনৈতিক পদক্ষেপের ঝড়:
পাকিস্তানের নাগরিকদের বহিষ্কার, ইন্দাস পানি চুক্তি স্থগিত করা– যেটি পাকিস্তানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি দেশের ৮০ শতাংশেরও বেশি পানি সরবরাহ করে। পাকিস্তান পাল্টা জবাবে ভারতীয় নাগরিকদের বহিষ্কার করে ও শিমলা চুক্তি স্থগিত করে।
উভয় দেশই একে অপরের জন্য আকাশসীমা বন্ধ করেছে।
ভারতের পক্ষ থেকে সামরিক প্রতিক্রিয়া আসার সম্ভাবনাও রয়েছে।
বুধবার (৩০ এপ্রিল) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল এবং প্রতিরক্ষা প্রধান জেনারেল অনিল চৌহানের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেন।
সূত্র জানিয়েছে, তিনি সেনাবাহিনীকে পাল্টা হামলার জন্য পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন।
এই পরিস্থিতির মধ্যেই ভারত-পাকিস্তান আবারও যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। টানা অষ্টম দিনের মত সীমান্তে গলাগুলি করেছে দুই প্রতিবেশী দেশ।
সূত্র: এনডিটিভি
আপনার মতামত লিখুন :