চার দিনের যুদ্ধের পর ভারত ও পাকিস্তান সম্প্রতি একটি পূর্ণাঙ্গ ও তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তির ঘোষণা দিয়েছেন।
গত সপ্তাহে, পাকিস্তান ভারতের মধ্যে পাল্টা আক্রমণ শুরু হয়। দুই পক্ষই দাবি করেছে যে, তারা বেশিরভাগ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করেছে, তবে কিছু আঘাতে দুদেশেরই ক্ষতি হয়েছে।
ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে একটি অভিযান চালায়, যার ফলে পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে ১৩ জন নিহত হয়। পাকিস্তানও ‘অপারেশন বুনইয়ানুম মারসুস’ নামে পাল্টা আক্রমণ চালায়।
এই সংঘর্ষে ৬০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য, দুই দেশই পারমাণবিক অস্ত্রধারী, যা বৃহত্তর সংঘর্ষের আশঙ্কা তৈরি করেছিল।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চুক্তি কী ছিল?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শনিবার (১০ মে) ঘোষণা করেন, ভারত ও পাকিস্তান একটি পূর্ণাঙ্গ ও তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছেছে। তিনি দুই দেশের নেতাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইশাক দার এবং ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি যুদ্ধবিরতির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তারা বলেছেন, ‘দুই পক্ষই স্থল, আকাশ ও সমুদ্রে সব ধরনের সামরিক কার্যক্রম বন্ধ করবে।’
দুদেশই সামরিক চ্যানেল ও হটলাইন চালু করেছে।
আরও আলোচনা হবে কি?
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, ‘ভারত ও পাকিস্তান একটি নিরপেক্ষ স্থানে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করবে।’
তবে, ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এই দাবি অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, ‘কোনও নতুন আলোচনা শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।’
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী শান্তি প্রতিষ্ঠা কঠিন হবে, কারণ পূর্বে এমন প্রচেষ্টা সফল হয়নি।
যুদ্ধ ঘোষণা হয়েছে কি?
সরকারিভাবে, দুই দেশই যুদ্ধ ঘোষণা করেনি। তারা নিজেদের সামরিক কার্যক্রমকে ‘বিশেষ সমন্বিত সামরিক অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
পাকিস্তান ‘অপারেশন বুনইয়ানুম মারসুস’ নামে পাল্টা আক্রমণ চালায়, আর ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে অভিযান চালায়।তবে এ পরিস্তিতি নতুন কিছু নয়। অতীতেও দুই দেশই যুদ্ধ ঘোষণা না করেই বড় ধরনের সংঘর্ষে জড়িয়েছে।
পূর্বে কি তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা সফল হয়েছে?
হ্যাঁ, ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভাজনের পর থেকে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতায় বেশ কয়েকটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে।
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় কাশ্মীর নিয়ে প্রথম যুদ্ধবিরতি হয়। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর তাসখন্দ চুক্তি হয়, যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতা ছিল। ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধের পরও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মধ্যস্থতায় পাকিস্তানকে পিছু হটতে বাধ্য করা হয়।
তবে, দীর্ঘমেয়াদী শান্তি প্রতিষ্ঠা এখনও সম্ভব হয়নি।
যুদ্ধ কীভাবে সংজ্ঞায়িত হয়?
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী, ‘আন্তর্জাতিক সশস্ত্র সংঘর্ষ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এটি কোনো দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা না করলেও, দুই দেশের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাম্প্রতিক উত্তেজনা মূলত শক্তির প্রদর্শন এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ন্ত্রণের অংশ ছিল।
যুদ্ধ ঘোষণা না করার কারণ কী?
জাতিসংঘের চার্টার অনুযায়ী, ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা করা আইনগতভাবে অবৈধ শক্তি প্রয়োগ হিসেবে বিবেচিত হয়। এতে আন্তর্জাতিক আইনি বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়, যেমন যুদ্ধাপরাধের জন্য জবাবদিহিতা।
এছাড়া, সরকারগুলো নিজেদের সামরিক কার্যক্রমকে ‘বিশেষ অভিযান’ বা ‘প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়, যা তাদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হয়।
কেন দেশগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করতে চায় না?
১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ সনদ গৃহীত হওয়ার পর থেকে, আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধ ঘোষণা করাকে বেআইনি বলেই ধরা হয়।
আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ আহমের বিলাল সুফি আল জাজিরাকে জানান, এখন কোনো দেশ আর যুদ্ধ শব্দটি ব্যবহার করে না বা যুদ্ধ ঘোষণা করে না, কারণ এটি আন্তর্জাতিকভাবে বেআইনি শক্তি প্রয়োগ হিসেবে বিবেচিত।
একবার কোনো দেশ ‘সশস্ত্র সংঘর্ষে’ লিপ্ত হয়েছে বলে স্বীকার করলে, তাদের আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যুদ্ধের নিয়ম মেনে চলতে হয় এবং যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়বদ্ধ হতে হয়।
সম্প্রতি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনার সময়, উভয় পক্ষই একে অপরকে আগ্রাসনকারী হিসেবে উপস্থাপন করেছে এবং নিজেদেরকে আত্মরক্ষাকারী বলে দাবি করেছে।
যুদ্ধ শব্দটির কোনো নির্দিষ্ট, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সংজ্ঞা না থাকায়, দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে সামরিক অভিযান চালিয়ে যেতে পারে- যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়াই। এই অস্পষ্টতাই সরকারগুলোকে সুযোগ দেয় তাদের সামরিক পদক্ষেপকে রাজনৈতিক বা কূটনৈতিকভাবে সুবিধাজনক ভাষায় তুলে ধরতে।
উদাহরণ:
রাশিয়া ২০২২ সালে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার হামলা চালিয়েও একে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ বলে অভিহিত করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫০-এর দশকে কোরিয়ান যুদ্ধকে ‘পুলিশি অভিযান’ বলেছিল এবং আফগানিস্তান ও ইরাকে দীর্ঘমেয়াদী সামরিক উপস্থিতিকে ‘সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান’ হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
ইসরায়েল প্রায়ই তাদের সীমান্তের বাইরের সামরিক হামলাগুলোকে ‘সামরিক অভিযান’ বলে ঘোষণা করে, যেমন ২০১৪ সালের গাজায় ‘অপারেশন প্রোটেকটিভ এজ’।
এইসব শব্দ চয়ন মূলত নিজেদের দেশের জনগণের কাছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার এবং আন্তর্জাতিকভাবে আইনগত জটিলতা এড়ানোর একটি উপায় মাত্র।
আপনার মতামত লিখুন :