ইরানে পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় হামলার জবাবে ইসরায়েলে ‘শত শত বিভিন্ন ধরনের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র’ নিক্ষেপ করেছে ইরান। যা সম্প্রতি দুদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় হামলা। এই হামলার পেছনে রয়েছে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি থামানোর প্রচেষ্টা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এই হামলার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছিল চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকেই। মার্কিন গোয়েন্দারা ইরানের পরমাণু সংশ্লিষ্ট স্থাপনায় ইসরায়েলের হামলার সতর্কতা দিয়ে আসছে অনেক আগে থেকেই।
তারা বলেছিল, ইরানের পারমাণবিক বোমা বানানোর প্রকল্প নিয়ে বেশ উদ্বেগে আছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং ইরানকে এই অস্ত্র তৈরি করা থেকে বিরত রাখতে দেশটিতে সামরিক হামলা চালানো ব্যতীত অন্য কোনো বিকল্প উপায়ে ‘আগ্রহী’ নন তিনি।
ইরানের পরমাণু প্রকল্প ধ্বংস ও ইরানের ইসলামপন্থি সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে ইরানে হামলার পরিকল্পনা করছেন নেতানিয়াহু।
দীর্ঘদিন ধরে ইরানের মদদপুষ্ট গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলে চোরাগুপ্তা হামলা চালিয়ে আসছিল। তবে গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভূখণ্ডে হামাসের অতর্কিত হামলার পর গাজায় যখন সামরিক অভিযান শুরু করে আইডিএফ, সে সময় নতুনভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে হুতি ও হিজবুল্লাহ।
ইরানের পরমাণু প্রকল্প সরাসরি ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হওয়ায় এবং গাজা অভিযান ও কারাবন্দি উদ্ধারে স্থবিরতায় জনসমর্থন কমেছে নেতানিয়াহুর।
এদিকে, সম্প্রতি ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেটে সরকার পতনের ভোটে স্বল্প ব্যবধানে বেঁচে যায় নেতানিয়াহুর সরকার।
সে জন্য নিজের ও দেশের স্বার্থে ইরানের পরমাণু প্রকল্পে হামলা করে নেতানিয়াহু।
এবার ইরানের রাজধানী তেহরানসহ ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বিমান ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল। এতে ইসলামি রেভল্যুশনারি গার্ডের কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল হোসেইন সালামিসহ কয়েকজন শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে ইরানি সংবাদমাধ্যম।
ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ইরনা জানিয়েছে, ইসরায়েলি বিমানবাহিনী তেহরান, ইসফাহান, আরাক, তাবরিজ, কারমানশাহ এবং রাতানজ শহরে সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করে একযোগে হামলা চালায়। বিশেষ করে রাতানজ শহরের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র, তাবরিজের পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র ও সামরিক ঘাঁটিগুলোতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।
এই অভিযানের পর ইসরায়েলজুড়ে জারি করা হয়েছে ‘বিশেষ জরুরি অবস্থা’। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ইরান থেকে সম্ভাব্য পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার আশঙ্কায় এই সতর্কতা নেওয়া হয়েছে।
এক বিবৃতিতে খামেনি বলেন, ইহুদিবাদী সরকার আমাদের প্রিয় দেশের বুকে তার রক্তাক্ত ও কলুষিত হাত বিস্তার করেছে, আবাসিক এলাকায় হামলা চালিয়ে আগের থেকেও স্পষ্টভাবে তার বর্বর স্বভাব প্রকাশ করেছে। এর জন্য তাদের কঠিন শাস্তি ভোগ করতেই হবে।
তিনি বলেন, এই হামলার মাধ্যমে ইহুদিবাদীরা নিজেদের জন্য এক তিক্ত ও যন্ত্রণাদায়ক পরিণতি ডেকে এনেছে এবং তা তাদের ভোগ করতেই হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শত্রুর এই আক্রমণে আমাদের কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা ও বিজ্ঞানী শহীদ হয়েছেন। তবে ইনশাআল্লাহ, তাদের স্থলাভিষিক্তরা দ্রুতই সেই দায়িত্ব তুলে নিয়ে কাজ শুরু করবেন। ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনী আল্লাহর ইচ্ছায় ইসরাইলের মতো শত্রুদের কখনো ছাড় দেবে না।’
পাল্টা জবাব হিসেবে ইসরায়েলের গর্বিত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘আয়রন ডোম’ ভেদ করে ‘শত শত বিভিন্ন ধরনের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র’ নিক্ষেপ করেছে ইরান। এতে ৪১ জন আহত হয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে, ইরানকে প্রতিহত করতে হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল।
বিশ্লেষকদের ধারণা অনুযায়ী, ইসরায়েলের এই হামলার প্রতিশোধ নিতে ইরান হয়ে উঠতে পারে আরও ভয়াবহ। সরাসরি সামরিক হামলা থেকে শুরু করে সাইবার যুদ্ধেও জড়াতে পারে।
এর আগে, ২০২৪ সালের এপ্রিলে ইরান প্রথমবারের মতো ইসরায়েলে সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়- যা ছিল যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এবারও মিসাইল ও ড্রোন হামলার মাধ্যমে উত্তর ইসরায়েল, সামরিক ঘাঁটি বা বেসামরিক অবকাঠামো লক্ষ্যবস্তু হতে পারে।
প্রক্সি বাহিনী ব্যবহার
ইরান হিজবুল্লাহ (লেবানন), হুথি (ইয়েমেন), ফাতেমিয়ুন/জয়নাবিয়ুন ব্রিগেড (সিরিয়া/আফগানিস্তান), হাশদ আল-শাবি (ইরাক)- এসব প্রভাবিত গ্রুপের মাধ্যমে বিভিন্ন ফ্রন্টে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চাপ তৈরি করতে পারে।
এ ছাড়াও গাজা সীমান্তে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করা, লেবাননের দক্ষিণ সীমান্ত থেকে রকেট হামলা বাড়ানো হতে পারে কৌশলের অংশ।
সাইবার যুদ্ধ
ইরান অতীতে ইসরায়েলের পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ এবং ব্যাংকিং সেক্টরে সাইবার হামলা চালিয়েছে। এবার বড় ধরনের সাইবার প্রতিশোধ নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যার মাধ্যমে ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো অচল করে দিতে পারে।
বিশ্ববাজারে অস্থিরতা
হরমুজ প্রণালি দিয়ে বিশ্বের প্রায় ২০% তেল পরিবাহিত হয়। ইরান চাইলে এখানে উত্তেজনা সৃষ্টি করে বিশ্ববাজারে তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ঘটাতে পারে। এটি পশ্চিমা বিশ্বের ওপর অর্থনৈতিক চাপ হিসেবে কাজ করবে।
কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক লবি
ইরান জাতিসংঘ ও ওআইসির মাধ্যমে ইসরায়েলকে যুদ্ধাপরাধী আখ্যা দিতে কাজ করতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি, কাতার ও তুরস্কের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে ইসরায়েলবিরোধী ঐক্য গড়ে তোলা হতে পারে।
পারমাণবিক কর্মসূচি ত্বরান্বিত করা
ইসরায়েলের হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরান পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ আরও দ্রুততর করার ঘোষণা দিতে পারে, যা পশ্চিমা বিশ্বের ওপর কৌশলগত চাপ সৃষ্টি করবে। এটি সম্ভাব্য ‘চূড়ান্ত প্রতিশোধ কৌশল’ হিসেবেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
এদিকে, ইরান-ইসরায়েল পাল্টাপাল্টি হামলার মধ্যে বড় ধরনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে সব মার্কিন সামরিক ঘাঁটি সক্রিয় করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এসব ঘাঁটির সক্ষমতার পাশাপাশি বাইরে থেকে যুদ্ধজাহাজ আনা হচ্ছে। ইরানের বিরুদ্ধে সে যুদ্ধজাহাজ কাজে লাগানো হতে পারে। ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে সক্ষম ধ্বংসকারী যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস টমাস হাডনারকে পশ্চিম ভূমধ্যসাগর থেকে পূর্ব ভূমধ্যসাগরের দিকে যাত্রা শুরু করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসকারী জাহাজকেও অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে হোয়াইট হাউসের অনুরোধে তা প্রস্তুত থাকতে পারে।
অন্যদিকে, বিমানঘাঁটিগুলোতে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। তবে বিষয়গুলো এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। এখনো এসব চলমান সামরিক অভিযানের অংশ।
আপনার মতামত লিখুন :