ইসরায়েলি হামলায় ফিলিস্তিনের গাজায় অন্তত ২৩৮ জন গণমাধ্যমকর্মী নিহত হয়েছেন। নিহত সাংবাদিকের এ সংখ্যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, আফগানিস্তান যুদ্ধ এবং যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধে সম্মিলিতভাবে নিহত হওয়া মোট সাংবাদিকের সংখ্যার চেয়েও বেশি। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি নৃশংসতায় গাজা সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান হয়ে উঠছে।
সম্প্রতি আল শিফা হাসপাতালের বাইরে সাংবাদিকদের তাঁবুতে হামলায় আলজাজিরার চার সাংবাদিকের মৃত্যুর পর গাজার সাংবাদিকদের মধ্যে নতুন করে মৃত্যুর আতঙ্ক দানা বাঁধছে। প্রেসের ভেস্ট আর হেলমেট একসময় ঢাল হিসেবে বিবেচিত হলেও এখন এসবের কারণেই লক্ষ্যবস্তু হতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন আলজাজিরার সংবাদদাতা হানি মাহমুদ। বলেন, ‘সার্বক্ষণিক একটা আতঙ্কের মধ্যে থাকছি। বেঁচে ফিরতে পারব তো? প্রতিটি অ্যাসাইনমেন্টে যাওয়ার আগে এই ভয়টা জেঁকে বসে।’
এদিকে সাংবাদিক হত্যার জন্য সেই একই পুরোনো সাফাই গেয়ে চলেছে ইসরায়েলি প্রশাসন। তাদের ভাষ্য যেসব সাংবাদিক হামাসের সদস্য, কেবল তাদেরই টার্গেট করা হয়। গত ১০ আগস্ট নিহত হওয়া চার সাংবাদিকের মধ্যে আনাস আল শরীফ নামের একজনের বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ এনেছে তারা। তবে, এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি তারা। এ ছাড়া, বাকি তিনজনকেই বা কেন হত্যা করা হলো, তার কোনো কৈফিয়ত দিতে পারেনি ইসরায়েল।
সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা একাধিক আন্তর্জাতিক সংগঠন অভিযোগ করে জানায়, ইসরায়েল সাংবাদিক হত্যার ক্ষেত্রে নিয়মিতভাবে ‘হামাস সদস্য হওয়ার অভিযোগ’কে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসও (সিপিজে) ইসরায়েলি এমন কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।
সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক সারা কুদাহ বলেন, ‘আল-শরিফের বিরুদ্ধে হামাসের সদস্য হওয়ার যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। যুদ্ধের শুরু থেকেই আলজাজিরার সাংবাদিক হিসেবে অনেক সাহসী কাজ তিনি করে আসছিলেন। যখনই যুদ্ধে ইসরায়েলের কোনো একটা কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শক্তিশালী কোনো প্রতিবেদন তিনি তৈরি করেছেন, তখনই এ ধরনের অপবাদ দেওয়া হতো। ত্রাণ প্রবেশে ইসরায়েলি বাধার কারণে উপত্যকায় দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি নিয়ে তার প্রতিবেদনটি এ ধরনের অপবাদের সবশেষ উদাহরণ। আর শুধু আল-শরিফ একা নন, অনেকেই এভাবে লক্ষ্যবস্তু হচ্ছেন।’
আন্তর্জাতিক পরিসর থেকে গাজার মানুষের দুর্দশার চিত্র মুছে দিতেই সাংবাদিকদের ওপর ইসরায়েল নিয়মিতভাবে এই আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানালেন আল-কুদস ওপেন ইউনিভার্সিটিতে মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক হুসেইন সাদ। তার মতে, ইসরায়েল যেহেতু নিয়মিতভাবে সাংবাদিকদের টার্গেট করছে, তাই গাজার সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীরা এখন ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন—তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নেবেন, নাকি নিরাপত্তার জন্য কাজ থেকে সরে দাঁড়াবেন।
গাজার বাসিন্দাদের অনাহার, ভোগান্তি, দুর্দশা নিয়ে যখন প্রতিবেদন লিখছেন, তখন সাংবাদিকেরা নিজেরাও একই কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। আলজাজিরার সংবাদদাতা ও ফটোসাংবাদিক আমর আল-সুলতান জানান, বর্তমানে তাঁর জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষুধা। বলেন, ‘এমনও হয়েছে যে খাওয়ার জন্য একটা দানা ছিল না আমার কাছে। শুধু পানি খেয়ে কাজে গেছি। টানা দু-তিন দিন শুধু পানি খেয়ে জীবন ধারণ করেছি আমি। এই যুদ্ধে অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়েই যেতে হচ্ছে। তবে এটাই আমার কাছে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ বলে মনে হচ্ছে।’
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন