এই সপ্তাহের শুরুতে ইথিওপিয়ার আফার অঞ্চলের কর্তৃপক্ষ টাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট (টিপিএলএফ)-এর বিরুদ্ধে আফারে নতুন করে আক্রমণ শুরু করার অভিযোগ এনেছে। কর্মকর্তাদের দাবি, টিপিএলএফ আফার সীমান্ত অতিক্রম করে ছয়টি গ্রাম দখল করেছে এবং মেগালে জেলায় বেসামরিক এলাকায় মর্টার হামলা চালিয়েছে। কর্তৃপক্ষ এই ঘটনাকে ২০২২ সালের প্রিটোরিয়া শান্তি চুক্তির গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে অভিহিত করেছে, যা ইথিওপিয়ার উত্তরাঞ্চলের নৃশংস যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছিল। আফার প্রশাসন এটিকে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ বলে নিন্দা জানিয়ে সতর্ক করেছে, প্রয়োজনে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
যুদ্ধের ছায়া ও শান্তিচুক্তির সীমাবদ্ধতা
২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে উত্তর ইথিওপিয়া বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সংঘাতগুলোর একটি হিসেবে চিহ্নিত ছিল। প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদের নেতৃত্বাধীন ফেডারেল সরকার ও টিপিএলএফ-এর মধ্যকার এই যুদ্ধে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ নিহত এবং লক্ষাধিক বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। যুদ্ধ চলাকালে গণহত্যা, যৌন সহিংসতা ও মানবিক অবরোধের মতো নৃশংসতার খবরও প্রকাশ পেয়েছিল।
প্রিটোরিয়া চুক্তি যুদ্ধের অবসান ঘটালেও, এটি বহু প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিত রেখে যায়। শান্তি প্রক্রিয়ায় অংশ না নেওয়া প্রতিবেশী ইরিত্রিয়া এই চুক্তিকে তার যুদ্ধকালীন লক্ষ্য থেকে সরে আসা হিসেবে দেখে। তাদের মতে, চুক্তিটি টিপিএলএফকে ধ্বংস না করে বরং বৈধতা দিয়েছে।
শান্তি চুক্তির পরও ইরিত্রিয়ান বাহিনী কয়েক মাস টাইগ্রের কিছু অংশে অবস্থান করে, এর ফলে ইথিওপিয়া-ইরিত্রিয়া সম্পর্ক দ্রুত অবনতির দিকে যায়। ২০২৩ সালের মাঝামাঝি থেকে ইথিওপিয়া সীমান্ত এলাকায় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু করে এবং ইরিত্রিয়ান সেনাদের প্রত্যাহারে চাপ দেয়।
২০২৪ সালে প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ দেশের আঞ্চলিক রাজ্যগুলোর ওপর ফেডারেল কর্তৃত্ব জোরদার করার নীতি গ্রহণ করেন। ইরিত্রিয়ার কাছে এটি ছিল এক ধরনের হুমকি, কারণ তারা দীর্ঘদিন ধরে একটি শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ ইথিওপিয়াকে তাদের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক মনে করে এসেছে। এই পরিস্থিতি টিপিএলএফ ও ইরিত্রিয়াকে সতর্কভাবে কাছাকাছি এনেছে।
লোহিত সাগর ইস্যুতে নতুন বিরোধ
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দুই দেশের সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়েছে। ইথিওপিয়া জাতিসংঘকে জানায় যে- ইরিত্রিয়া যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং টিপিএলএফ-এর সঙ্গে মিলে দেশটিকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র করছে।
এই অভিযোগ ইরিত্রিয়া অস্বীকার করে পাল্টা সেনা প্রস্তুতি বাড়ায় এবং মিশরের সঙ্গে কৌশলগত যোগাযোগ জোরদার করে।
স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, দুই দেশের সীমান্তে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষত আসাব বন্দরের কাছে- যা ইথিওপিয়ার জন্য সামুদ্রিক প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে অক্টোবরের শেষ দিকে ইথিওপিয়ার সংসদে এক উত্তেজনাপূর্ণ ভাষণে দেশটির প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ বলেন, লোহিত সাগরে ইথিওপিয়ার অধিকার ‘অপরিবর্তনীয়’ এবং সতর্ক করেন, ‘একবার যুদ্ধ শুরু হলে কেউ আমাদের থামাতে পারবে না।’
এ সময় তিনি জোর গলায় বলেন, ১৯৯৩ সালে ইরিত্রিয়ার স্বাধীনতার পর ইথিওপিয়া কীভাবে সমুদ্রপথ হারিয়েছিল তার কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি নেই, ফলে দেশটির ঐতিহাসিকভাবে সমুদ্রপ্রবেশাধিকারের অধিকার এখনো বৈধ।
নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা
বিশ্লেষকদের মতে, ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়ার মধ্যে উত্তেজনা যদি পূর্ণাঙ্গ সংঘাতে রূপ নেয়, তবে এর প্রভাব আফ্রিকার শিং অঞ্চল ছাড়িয়ে বৈশ্বিক বাণিজ্যেও পড়তে পারে। দুই দেশই বাব এল-মান্দেব প্রণালীর নিকটে অবস্থিত- যা লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরকে সংযুক্ত করে। এই প্রণালীর মাধ্যমে বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় ১০ শতাংশ পণ্য পরিবহন হয়। যেকোনো সংঘাত এই গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক রুট, আঞ্চলিক বন্দর এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।
এরই মধ্যে সুদানের গৃহযুদ্ধ, সোমালিয়ার রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ইয়েমেনের চলমান সংঘাতের কারণে অস্থির থাকা এই অঞ্চলে নতুন যুদ্ধ আরও অস্থিতিশীলতা ডেকে আনতে পারে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন