আফ্রিকার বহু দেশে এখনো জাদুবিদ্যার অভিযোগকে কেন্দ্র করে নারীদের ওপর নির্যাতন, গণপিটুনি, সম্প্রদায়চ্যুত করা এবং নৃশংসভাবে হত্যা- এসব ঘটনা উদ্বেগজনক হারে চলছে। আইন থাকা সত্ত্বেও সামাজিক কুসংস্কার, আদিবাসী আচার, ব্যক্তিগত শত্রুতা ও দুর্বল বিচারব্যবস্থার কারণে এসব অপরাধ প্রায়ই অদণ্ডিত থেকে যায়। ফলে ‘উইচ-হান্ট’ মহাদেশজুড়ে এক গুরুতর মানবাধিকার সংকটে রূপ নিয়েছে। সম্প্রতি সিয়েরা লিওনে মোবাইলে ধারণ করা একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
ভিডিওতে দেখা গেছে- গ্রামের কিছু যুবক জাদুবিদ্যার অভিযোগে এক বৃদ্ধা নারীকে পিটিয়ে হত্যা করছে। তাদের দাবি, ওই নারী নাকি গ্রামে মানুষের মৃত্যু ঘটাচ্ছিলেন। এমন ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড প্রকাশ্যে ঘটলেও স্থানীয়ভাবে কেউ প্রতিরোধ করেনি; বরং ঘটনাটিকে অনেকে ‘দৈব বিচারের বাস্তবায়ন’ বলে সমর্থন করেছে।
এ ঘটনায় সিয়েরা লিওন সরকার নিন্দা জানালেও মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে- এ ধরনের অপরাধ বহু বছর ধরে ঘটছে, কিন্তু বিচার প্রায় শূন্য।
একবিংশ শতাব্দীতেও আফ্রিকার বহু অঞ্চলে জাদুবিদ্যায় বিশ্বাস ভীষণ দৃঢ়। অসুস্থতা, মৃত্যু, খরা, দুর্ভিক্ষ বা কোনো ব্যক্তিগত ক্ষতি- এসব ঘটলেই দায় চাপানো হয় সমাজের সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তি, বিশেষত বৃদ্ধা নারী বা একাকী স্ত্রীলোকের ওপর। কারো বিরুদ্ধে শত্রুতা, জমিজমা নিয়ে বিরোধ বা সম্পত্তি দখলের আগ্রহ থাকলেই তাকে ‘উইচ’ ঘোষণা করা অনেক সহজ। প্রায় সব ক্ষেত্রে অভিযুক্ত হন নারী- যারা সমাজে ক্ষমতাহীন, আর্থিকভাবে দুর্বল বা পরিবারের উপর নির্ভরশীল।
বর্তমানে অন্তত ৩৫টি দেশে জাদুবিদ্যা সম্পর্কিত আইন বিদ্যমান, যেগুলোর প্রয়োগ বাস্তবে বিপরীত প্রভাব ফেলছে। আইন থাকা সত্ত্বেও জাদুবিদ্যার অভিযোগকে অপরাধ হিসেবে মেনে নেয়া মানে পুরোনো কুসংস্কারকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া। ফলে আইন নিজের উদ্দেশ্যেই ব্যর্থ হয়ে সমাজে আরও বেশি ভীতি, সহিংসতা ও অপরাধ সৃষ্টি করছে।
অধিকাংশ ঘটনায় দেখা যায়, অভিযুক্ত নারীর ওপর হামলা বা হত্যাকাণ্ড ঘটলেও সেই অপরাধ বিচারের আওতায়ই আসে না। স্থানীয় ট্রাইবাল কোর্ট, চিফডম এবং ধর্মীয় নেতাদের সিদ্ধান্তই অনেক এলাকায় চূড়ান্ত হিসেবে মানা হয়।
জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বহু বছর ধরে সতর্ক করে আসছে, জাদুবিদ্যার অভিযোগে সংঘটিত সহিংসতা আফ্রিকায় একটি ‘নীরব গণহত্যা’- যেখানে বার্ষিক হত্যার প্রকৃত সংখ্যা কোনো রেকর্ডেই নেই। সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে নারী, শিশু, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী এবং অ্যালবিনো জনগোষ্ঠী। পূর্ব আফ্রিকার তানজানিয়া ও মালাউইতে অ্যালবিনো মানুষের ওপর আক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
স্থানীয় কুসংস্কার অনুযায়ী, অ্যালবিনোদের শরীরের অংশ নাকি কালো জাদুর শক্তি বৃদ্ধি করে; এই বিশ্বাসে তাদের ওপর হামলা, অঙ্গ কেটে নেওয়া কিংবা হত্যা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। অনেক অ্যালবিনো শিশু দিনের আলোতেও নিরাপদে বাইরে যেতে ভয় পায়।
নানা ধর্মীয় নেতা, ভুডু-চিকিৎসক, ঐতিহ্যবাহী ওঝা বা পুরোহিতরা কুসংস্কার উসকে দেওয়ার ভূমিকা রাখেন। অনেক ক্ষেত্রে তারা অর্থ, প্রভাব বা ব্যক্তিগত স্বার্থে কাউকে ‘উইচ’ ঘোষণা করেন এবং সমাজকে উস্কে দেন সহিংসতায়। বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি- ইমপিউনিটি-এই সহিংসতাকে আরও উৎসাহিত করে। সরকারগুলোর সচেতনতা কর্মসূচি থাকলেও সামাজিক বিশ্বাসের গভীরতা এত শক্তিশালী যে আইন ও রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা সেখানে কার্যকর হতে পারে না।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, জাদুবিদ্যার নামে সহিংসতা বন্ধ করতে হলে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ, দ্রুত বিচার নিশ্চিতকরণ, ধর্মীয় ও কমিউনিটি নেতাদের জবাবদিহি, এবং দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক সচেতনতা- এসব একসঙ্গে বাস্তবায়ন ছাড়া পথ নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সমাজে কুসংস্কার ও ভীতি নির্মূল না হলে নারী নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও সামাজিক উন্নয়ন- সবকিছুই বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকবে। আফ্রিকার বহু অঞ্চলে জাদুবিদ্যার অভিযোগ আজও শুধু একটি বিশ্বাস নয়—বরং এটি নারী নিপীড়ন, দখলদারি, সহিংসতা ও অমানবিকতার একটি কাঠামোগত রূপ।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন