মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপিত ৫০ শতাংশ শুল্ক ভারতের তৈরি পোশাক শিল্পে বিরূপ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই উচ্চ শুল্ক আরোপের কারণে বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো ভারতে পোশাক অর্ডার স্থগিত বা বাতিল করে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ার মতো তুলনামূলক কম শুল্কপ্রাপ্ত দেশগুলোর দিকে ঝুঁকছে।
ভারতের ইংরেজি দৈনিক দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের নিটওয়্যার রাজধানী তামিলনাড়ুর তিরুপ্পুরের রপ্তানিকারকরা ইতোমধ্যে মার্কিন শুল্কের প্রভাব স্পষ্টভাবে অনুভব করছেন।
তারা জানাচ্ছেন, যারা আগে নিয়মিত মার্কিন বাজারে পোশাক সরবরাহ করতেন, তারা এখন নতুন অর্ডার দিতে দেরি করছেন কিংবা অন্য দেশে অর্ডার স্থানান্তর করছেন।
তামিলনাড়ুর রপ্তানিকারকদের কথায়, কিছু ক্রেতা তাদের অর্ডার স্থগিত রেখেছেন এবং কিছু ক্রেতা পাকিস্তান ও বাংলাদেশে অর্ডার সরিয়ে নিচ্ছেন, যেখানে শুল্ক হার ভারত থেকে অনেক কম, সাধারণত ১৯ থেকে ৩৬ শতাংশের মধ্যে রয়েছে।
এক রপ্তানিকারক জানিয়েছে, তার নিয়মিত মার্কিন চালান ইতোমধ্যে পাকিস্তানে চলে গেছে। অন্য একজন জানিয়েছেন, তার আমেরিকান ক্রেতারা গ্রীষ্মকালীন অর্ডার নিশ্চিত করার আগে অপেক্ষা করার অনুরোধ জানাচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক কাঠামোতে মূল শুল্কের পাশাপাশি অতিরিক্ত জরিমানা শুল্কও অন্তর্ভুক্ত, যা ভারতের কিছু নিটওয়্যার পোশাকের ক্ষেত্রে ৬৪ শতাংশে পর্যন্ত পৌঁছেছে। এর ফলে ভারতীয় পণ্যের দাম অঞ্চলীয় প্রতিযোগীদের তুলনায় প্রায় ৩৫ শতাংশ বেশি হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে মার্কিন শুল্ককে বড় ধরনের ধাক্কা হিসেবে দেখা হলেও এখন তা রপ্তানিকারকদের কাছে ‘বাণিজ্যিক অবরোধ’ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস আরও জানিয়েছে, তামিলনাড়ুর টেক্সটাইল শিল্প মার্কিন অর্ডারের পুনরুদ্ধারের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক তখনই নতুন অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। তিরুপ্পুর, কোয়েম্বাটুর ও কারুর শিল্পাঞ্চলে ১২ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করে, যেখানে বছরে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি রুপির পোশাক রপ্তানি হয়।
মার্কিন শুল্কের চাপ বৃদ্ধি পাওয়ার আগে ভারত-যুক্তরাজ্যের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) এবং চীন ও মিয়ানমারের উপর উচ্চ শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের ভারতীয় পণ্যের প্রতি আগ্রহ বাড়ার আশায় রপ্তানিকারকরা নতুন যন্ত্রপাতিতে বিনিয়োগও করেছিলেন। কিন্তু এখন সেই আশা ভেস্তে গেছে।
তিরুপ্পুর এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (টিইএ) সভাপতি কে এম সুব্রাহ্মনিয়ান বলেন, ‘এটি আমাদের জন্য একটি বড় ধাক্কা। আমরা যেখানে ৫ থেকে ৭ শতাংশ মুনাফায় কাজ করি, সেখানে অতিরিক্ত শুল্কের বোঝা ভাগাভাগি করা অসম্ভব। তিরুপ্পুর রপ্তানির ৩০ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রে যায় এবং ক্রেতারা ইতোমধ্যে আমাদের শুল্কের অংশ ভাগাভাগি করতে বলছে।’
তিনি বলেন, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের ক্রেতারা কিছুটা সুরক্ষা দিতে পারে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ব্র্যান্ডের বাইরের ক্রেতারা দ্রুত সস্তা বিকল্প খুঁজে নিচ্ছে।
এটি শ্রমিকদের জন্য আশঙ্কাজনক, কারণ টেক্সটাইল খাত সংকুচিত হলে ব্যাপক কর্মসংস্থানের ধাক্কা লাগবে। আগামী কয়েক মাসে তিরুপ্পুর, কারু ও কোয়েম্বাটুরে ১ থেকে ২ লাখ শ্রমিকের চাকরি হারানোর ঝুঁকি দেখা দিচ্ছে।
তামিলনাড়ুর তিরুপ্পুর থেকে প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার কোটি রুপির নিটওয়্যার রপ্তানি হয়। এখানে ওয়ালমার্ট, গ্যাপ, কস্টকোসহ বৈশ্বিক ব্র্যান্ডদের জন্য পোশাক তৈরি হয়, যা ভারতের নিটওয়্যার রপ্তানির ৫৫ শতাংশেরও বেশি।
রপ্তানিকারকরা ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ১০-১৫ শতাংশ বৃদ্ধির প্রত্যাশা করলেও মার্কিন শুল্কের কারণে বিশ্লেষকরা বলছেন, তুলা ও নিটওয়্যার পোশাকের মার্কিন অর্ডার ৪০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
শুল্কের প্রভাব কেবল পোশাক খাতেই সীমাবদ্ধ নয়। হোম টেক্সটাইলের জন্য বিখ্যাত কোয়েম্বাটুর ও কারুর কারখানাগুলোতেও বিদেশি অর্ডার স্থগিত হয়েছে।
সাউদার্ন ইন্ডিয়া মিলস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব কে সেলভারাজু জানান, গ্রীষ্মকালীন বিছানার চাদর ও তোয়ালের অর্ডার স্থগিত ও বিলম্বিত হচ্ছে, যা সাধারণত অক্টোবরের মধ্যে চূড়ান্ত হয়ে থাকে।
তিনি বলেন, ‘শুল্ক বৃদ্ধি ছাড়াও ভারতের তুলার ওপর ১১ শতাংশ আমদানি শুল্ক এবং জিএসটি-সংক্রান্ত অসংগতির ফলে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্ববাজারে আরও বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছে।’ পলিয়েস্টার কাঁচামালে ১৮ শতাংশ এবং সুতায় ১২ শতাংশ শুল্ক থাকলেও তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে তা মাত্র ৫ শতাংশ, যা রপ্তানির খরচে ৬-৭ শতাংশ অতিরিক্ত বাড়ায়।
এ ছাড়াও ব্রাজিল থেকে আমদানি করা তুলার মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সেলভারাজু দাবি করেন, ব্রাজিলের তুলা সবসময় মার্কিন মানদণ্ড পূরণ করতে পারে না। তিনি ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, মার্কিন শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়ে ব্রাজিল থেকে আমদানি করা তুলা থেকে তৈরি পোশাকের বিনিময়ে রপ্তানি চুক্তি করতে।
সুব্রাহ্মনিয়ান আরও বলেন, ‘বিশ্ববাজারে ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীরা এমন শাস্তিমূলক মার্কিন শুল্কের মুখোমুখি হয়নি। বাংলাদেশ ৩৫-৩৬ শতাংশ (বর্তমানে শুল্কহার কমে ২০ শতাংশ) শুল্ক বহাল রেখেছে, পাকিস্তান ১৯ শতাংশে নামিয়েছে, ভিয়েতনাম ২০-২১ শতাংশ এবং কম্বোডিয়া শুল্ক ১৯ শতাংশে নামিয়েছে। অন্যদিকে ভারতের শুল্ক ৫০ শতাংশ, যা নজিরবিহীন।’
তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘মার্কিন বাজারে আমাদের মুনাফা ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে এবং ক্রেতারা সস্তা বিকল্প খুঁজে নিচ্ছে। আমরা দ্রুত বাজার হারাতে পারি, যদি শুল্ক ব্যবস্থা অপরিবর্তিত থাকে।’
সেলভারাজু বলেন, ‘মার্কিন বাজার এখনও আমাদের পছন্দ করে, ভারতীয় মানও ভালো। কিন্তু রাজনৈতিক ও নীতিগত বাধাগুলো আমাদের পিছনে ফেলছে।’
আপনার মতামত লিখুন :