বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল উৎপাদন জোট ওপেক+ আবারও তাদের অবস্থানে অটল থেকে জুলাই মাসের জন্য প্রতিদিন অতিরিক্ত ৪ লাখ ১১ হাজার ব্যারেল উৎপাদন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। লক্ষ্য—বাজার শেয়ার পুনরুদ্ধার ও অতিরিক্ত উৎপাদনকারী সদস্যদের প্রতি কঠোর বার্তা দেওয়া।
দীর্ঘদিন ধরে দৈনিক ৫০ লাখ ব্যারেল বা বিশ্ব চাহিদার ৫ শতাংশ উৎপাদন সীমিত রাখার পর ওপেক+ চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ধাপে ধাপে উৎপাদন বাড়াতে শুরু করেছে। মে ও জুনে তা তিনগুণ করে, এবার জুলাইয়ে একই মাত্রা বজায় রাখছে।
বিশ্লেষকদের মতে, অতিৃরিক্ত সরবরাহের কারণে তেলের দাম কমলেও সৌদি আরব ও রাশিয়ার নেতৃত্বে জোটটি বাজারে আধিপত্য ফেরাতে চায়। এবং ইরাক, কাজাখস্তানের মতো অতিরিক্ত উৎপাদনকারী দেশগুলোকে শাস্তি দিতেও বদ্ধপরিকর।
ওপেক+ বিষয়ক বিশ্লেষক হ্যারি চিলিংগিরিয়ান বলেন, ‘আজকের সিদ্ধান্ত দেখিয়ে দিল মূল লক্ষ্য এখন বাজার দখল। যদি দাম কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব না আনে, তাহলে তারা চাচ্ছে বিপুল পরিমাণ বিক্রির মাধ্যমে আয় করতে।’
শনিবার (৩১ মে) অনলাইনে বৈঠকে বসেছিল জোটের আটটি দেশ। তারা জুলাইয়ের উৎপাদন নির্ধারণ ছাড়াও অন্যান্য বিকল্প নিয়ে আলোচনা করেছে বলে জানিয়েছেন ওপেক+ এর একজন প্রতিনিধি।
গতকাল শুক্রবার জোটের আলোচনার সঙ্গে জড়িত সূত্রগুলো জানিয়েছিল, তারা আরও বড় মাত্রায় উৎপাদন বৃদ্ধিও বিবেচনা করছিল।
ওপেক+ জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল এবং বাজারের ভিন্ন কোনো সংকট নেই বলেই তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশ্বের মোট তেলের প্রায় অর্ধেক উৎপাদন করে ওপেক+, যার মধ্যে ওপেক সদস্য ও রাশিয়ার মতো মিত্ররাও রয়েছে।
তবে জোটের এই বাড়তি সরবরাহ তেলের দাম কমিয়ে দিচ্ছে, ফলে সব তেল উৎপাদনকারী দেশই চাপে পড়ছে, বিশেষত মার্কিন শেল তেল উৎপাদকদের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীরা।
রিস্টাডের ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষণ প্রধান ও সাবে ওপেক+ কর্মকর্তা হোর্হে লিওন বলেন, ‘ওপেক+ তিনটি বড় ধাক্কা দিয়েছে—মে ছিল সতর্কবার্তা, জুনে তা নিশ্চিত হলো, আর জুলাইয়ের ঘোষণা যেন সরাসরি যুদ্ধের সংকেত।’
এপ্রিল থেকে জোটের আট সদস্য মোট ১৩ লাখ ৭০ হাজার ব্যারেল উৎপাদন বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে, যা তাদের সংকোচনের ৬২ শতাংশ পুনরুদ্ধারের অংশ।
রাশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী আলেক্সান্ডার নভাকসহ জোট কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রীষ্মকালীন চাহিদা বাড়ার কারণে এখন উৎপাদন বাড়ানোর সময়।
ইউবিএস বিশ্লেষক জিওভান্নি স্টাউনোভো বলেন, ‘বাজার এখনও টাইট, অর্থাৎ অতিরিক্ত তেল শোষণ করতে পারবে। অনেক দেশ এখনো নির্ধারিত কোটা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, ফলে প্রকৃত বাড়তি সরবরাহ হবে তুলনামূলকভাবে কম।’
তবে শনিবারের বৈঠকে আলজেরিয়াসহ কয়েকটি দেশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিরতি চেয়েছিল বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
দামে পতন: চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে
তেলের দাম এপ্রিল মাসে প্রতি ব্যারেল ৬০ ডলারের নিচে নেমে আসে, যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ওপেক+ যখন মে মাসে উৎপাদন তিনগুণ বাড়ানোর ঘোষণা দেয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন শুল্ক আরোপ করেন, তখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দুর্বলতার শঙ্কা তৈরি হয়।
শুক্রবার বাজার বন্ধ হয় প্রতি ব্যারেল ৬৩ ডলারের নিচে।
বিশ্বব্যাপী তেলের চাহিদা ২০২৫ সালে গড়ে ৭ লাখ ৭৫ হাজার ব্যারেল দৈনিক বাড়বে বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক জরিপে বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (আইইএ) পূর্বাভাস অনুযায়ী, এই বৃদ্ধির পরিমাণ ৭ লাখ ৪০ হাজার ব্যারেল।
উল্লেখ্য, এপ্রিল থেকে যেসব আট সদস্য উৎপাদন বাড়াচ্ছে, তারা ২০২০ সালে করা ২.২ মিলিয়ন ব্যারেল দৈনিক সংকোচন নীতি ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করছে। তবে জোটের বাকি দুই স্তরের কাট (সংকোচন) এখনও ২০২৬ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে।
বিশ্লেষণ বলছেন, ওপেক+ এখন মূলত বাজার দখলের খেলায় নেমেছে। দাম কমলেও, তারা মনে করছে—পরিমাণ বাড়িয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে। তবে এই নীতি বিশ্বব্যাপী জ্বালানি ভারসাম্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে বলে আশঙ্কা।
আপনার মতামত লিখুন :