গোয়েন্দা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা মার্কিন কর্মকর্তাদের মতে, যদি যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দেয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে হামলার জন্য ইরান ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম প্রস্তুত রেখেছে।
মঙ্গলবার (১৭ জুন) নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যেই ইউরোপে প্রায় তিন ডজন জ্বালানিবাহী বিমান পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যা মার্কিন ঘাঁটিগুলোকে রক্ষাকারী যুদ্ধবিমানগুলোকে সহায়তা করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। অথবা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে সম্ভাব্য হামলায় জড়িত বোমারু বিমানের পরিসর বাড়াতে ব্যবহার করা হবে।
ইরানের সঙ্গে তাদের সংঘাতে হস্তক্ষেপের জন্য ইসরায়েল হোয়াইট হাউসকে চাপ দেওয়ায় মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যে আরও বিস্তৃত যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়ছে।
তারা জানিয়েছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরায়েলি অভিযানে যোগ দেয় এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ ইরানি পারমাণবিক স্থাপনা ফোর্ডোতে হামলা চালায়, তাহলে ইরান-সমর্থিত হুথি মিলিশিয়া প্রায় নিশ্চিতভাবেই লোহিত সাগরে জাহাজগুলোতে হামলা শুরু করবে। ইরাক ও সিরিয়ার ইরানপন্থী মিলিশিয়ারাও সেখানে মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে আক্রমণ করার চেষ্টা করবে।
অন্যান্য কর্মকর্তারা বলেছেন, আক্রমণের ক্ষেত্রে ইরান হরমুজ প্রণালীতে মাইনিং শুরু করতে পারে, যা পারস্য উপসাগরে আমেরিকান যুদ্ধজাহাজগুলোকে আটকানোর কৌশল।
কমান্ডাররা সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান ও সৌদি আরবসহ সমগ্র অঞ্চলের সামরিক ঘাঁটিতে আমেরিকান সেনাদের উচ্চ সতর্কতায় রেখেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪০ হাজারের বেশি সেনা মোতায়েন রয়েছে।
দুই ইরানি কর্মকর্তা স্বীকার করে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরায়েলের যুদ্ধে যোগ দেয়, তবে তেহরান ইরাক থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন ঘাঁটিতে আক্রমণ করবে, এবং আক্রমণে অংশ নেবে।’
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি সোমবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমাদের শত্রুদের জানা উচিত, তারা আমাদের উপর সামরিক আক্রমণ চালিয়ে কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারবে না। এবং ইরানের জনগণের উপর তাদের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে পারবে না।’
এ ছাড়াও তিনি যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে দোষ ইসরায়েল ও তার প্রধান মিত্রদের উপর বর্তাবে বলে জানিয়েছেন। মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, এই অঞ্চলে আমেরিকান ঘাঁটিতে আক্রমণ করার জন্য ইরানের খুব বেশি প্রস্তুতির প্রয়োজন হবে না। ইরানি সামরিক বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র বাহরাইন, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ঘাঁটিতে সহজেই আঘাত হানতে পারে।
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে মার্কিন বাহিনীর যুদ্ধে যোগদানের সম্ভাবনা বেড়েছে। কারণ ইসরায়েল তার অভিযান অব্যাহত রেখেছে এবং প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। ফ্রোডোর উপর হামলা ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতার কতটা ক্ষতি করবে বা অস্ত্র তৈরিতে কতক্ষণ বিলম্ব করবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের বর্তমান মজুদও দেশের বিভিন্ন স্থানে সুড়ঙ্গে লুকিয়ে আছে।
বেশ কয়েকজন আমেরিকান কর্মকর্তা বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে আরও উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য ইসরায়েলের মার্কিন সাহায্যের প্রয়োজন হবে। আমেরিকার সহায়তার মধ্যে থাকতে পারে ইসরায়েলি কমান্ডোদের বিমান সহায়তা প্রদান করা, যারা স্থলপথে ইরানে প্রবেশ করে।
তবে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সম্ভাব্য ফলাফল হলো ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর দিয়ে সজ্জিত মার্কিন বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমানের হামলা, যা তাত্ত্বিকভাবে ভূগর্ভস্থ ফ্রোডো স্থাপনার পাহাড়ে প্রবেশ করতে সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্ডোতে বা মার্কিন সহায়তায় যেকোনো হামলা ইরান ও তার মিত্রদের প্রতিশোধ নিতে প্ররোচিত করবে।
ইরান ও তার মিত্ররা অতীতে আমেরিকানদের ক্ষতি করতে সক্ষম হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন তাদের উপর হামলা জোরদার করার পর হুথিরা তাদের আক্রমণ রোধ করেছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা বারবার আমেরিকান যুদ্ধজাহাজে হামলা চালানোর চেষ্টা করেছে এবং বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলে আঘাত করেছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ইরান-সমর্থিত একটি মিলিশিয়া সিরিয়ার সীমান্তের কাছে জর্ডানে একটি মার্কিন ঘাঁটিতে ড্রোন হামলা চালিয়ে তিনজন আমেরিকান সৈন্যকে হত্যা করেছে।
আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি পৌঁছেছে। কিন্তু তা করবে কি না এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। যদি ইরান অস্ত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তারা একটি অস্ত্র তৈরি করতে পারবে। একটি অপরিশোধিত ও মৌলিক পারমাণবিক বোমা সম্ভবত আরও দ্রুত তৈরি করা যেতে পারে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বারবার বলেছেন, তিনি ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে দেবেন না। মঙ্গলবার তিনি ইরানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু ইসরায়েলি হামলা ইরানের হিসাব-নিকাশ বদলে দিতে পারে।
ইসরায়েলের অভিযান সম্পর্কে সন্দেহপ্রবণ মার্কিন কর্মকর্তারা মঙ্গলবার বলেছেন, এটি সম্ভবত তেহরানকে বোঝাতে পেরেছে যে, ভবিষ্যতের আক্রমণ প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হলো পূর্ণাঙ্গ পারমাণবিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
এই কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলেছেন, যাই হোক না কেন ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করে, তাহলে ট্রাম্প প্রশাসনের উপর হামলা চালানোর জন্য চাপ বাড়তে পারে।
কিন্তু আক্রমণাত্মক, সামরিকবাদী পররাষ্ট্রনীতির সমালোচকরা বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পিছু হটার জন্য এখনও খুব বেশি দেরি হয়নি।
সংযত পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে কাজ করে এমন একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ডিফেন্স প্রাইওরিটিসের মধ্যপ্রাচ্য প্রোগ্রামের পরিচালক রোজমেরি কেলানিক বলেছেন, ‘যুদ্ধ শুরু করার জন্য কখনও খুব বেশি দেরি হয় না’।
তিনি স্বীকার করেছেন ইসরায়েলের হামলা ইরানকে সম্ভাব্য পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য উৎসাহিত করেছে।
তবে কেলানিক আরও বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে যোগ দিলে প্রণোদনা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পাবে। একবার জড়িত হলে পিছু হটা সত্যিই কঠিন। তিনি বলেন। কেবল এগিয়েই যেতে হবে।’
আপনার মতামত লিখুন :