ঢাকা বুধবার, ১৬ জুলাই, ২০২৫

ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে ফিলিস্তিনিদের বাড়ি ভাঙছে ‘ইসরায়েল’

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ১৫, ২০২৫, ১১:৩২ পিএম
গাজায় ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বুলডোজারে। ছবি- সংগৃহীত

একটা সাধারণ সকাল। ফেসবুক স্ক্রল করছেন, হঠাৎ চোখে পড়ল এক চাকরির বিজ্ঞাপন ‘বুলডোজার চালক দরকার!’ প্রতিদিনের মজুরি ৩ হাজার শেকেল, মানে প্রায় ৮৮২ ডলার।

প্রথমে আপনার মনে হতেই পারে, নিশ্চয়ই তেলআবিব বা দখলকৃত জেরুজালেমে কোনো নির্মাণ প্রকল্পের কাজ। হয়তো নতুন কোনো শপিং মল বা হাইওয়ের। কিন্তু বিজ্ঞাপনের নিচে চোখ পড়তেই আপনি থমকে যাবেন। লেখা আছে ‘মিশন: গাজায় একটির পর একটি ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া।’

না, এটা কোনো ডার্ক থ্রিলার সিনেমার চিত্রনাট্য নয়। এটাই আজকের বাস্তব, আজকের ফিলিস্তিন। এ যেন চোখের সামনে ঘটে চলা এক আধুনিক গণহত্যা, যেখানে মৃত্যু আর ধ্বংসের মাঝেই চলেছে কর্মসংস্থানের বিজ্ঞাপন, যেন ধ্বংসই এখন পেশা।

ইহুদি বংশোদ্ভূত মার্কিন গবেষক ও গণহত্যা বিশেষজ্ঞ ওমর বারতোভ, যিনি বছরের পর বছর মানবিক বিপর্যয় নিয়ে গবেষণা করেছেন, তিনিও এই দৃশ্য দেখে হতবাক। বলছেন, ‘গাজার চিত্র আর সহ্য করতে পারছি না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে যিনি কাজ করেন, তার কাছেও এই বাস্তবতা অসহনীয়।’

তিনি জানান, গাজার ৭০ শতাংশ ভবন এখন ধ্বংসস্তূপ। প্রতিটি সপ্তাহে শত শত ঘরবাড়ি মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আগের মতো চুপিচুপি নয় এবার তা প্রকাশ্যেই, ফেসবুকের দেওয়ালে ঝুলছে এই ধ্বংসযজ্ঞের বিজ্ঞাপন।

যত ঘর ধ্বংস, তত টাকা

দ্য গার্ডিয়ানের সাংবাদিক এরওয়া মাহদাভি এমন এক ফেসবুক পেজের কথা বলেছেন, যেখানে সারি সারি বিজ্ঞাপন ‘বুলডোজার চালকের নিয়োগ’ চলছে জোরকদমে। প্রতিদিন ৮৮২ ডলার পর্যন্ত আয় করার প্রতিশ্রুতি ঝুলছে প্রতিটি পোস্টে। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয়টা এখানেই—বেতন নির্ধারিত হচ্ছে ঘর ভাঙার সংখ্যার ওপর!

একটা ছোট ঘর গুঁড়িয়ে দিলে মিলছে ২ হাজার ৫০০ শেকেল, আর বড় ভবন ভাঙলে ৫ হাজার শেকেল। অর্থাৎ, ধ্বংস যত বড়, আয় তত বেশি।

এই অর্থনীতির কেন্দ্রে এখন বুলডোজার, যা এককালে ছিল নির্মাণের প্রতীক, আজ তা পরিণত হয়েছে গণহত্যার যন্ত্রে।

আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ নেভ গর্ডনের কথায়, “বুলডোজার এখন গণহত্যার অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। আর ‘ইসরায়েল’ নিজে হাতে নয়, এই কাজ করাচ্ছে বেসামরিক ঠিকাদারদের দিয়ে।”

এক সময় ‘ইসরায়েল’ যে অজুহাত দিত, তাতে কেউ কেউ বিশ্বাস করত। এখন আর কেউ করে না।

তারা বলে, গাজার প্রতিটি ঘরেই নাকি যোদ্ধা থাকতে পারে, তাই সব ঘর ধ্বংস করতে হবে। তারা মাসের পর মাস জোর গলায় দাবি করেছিল, গাজার আশ-শিফা হাসপাতাল নাকি হামাসের গোপন ঘাঁটি। অথচ সেখানে কিছুই মেলেনি, না অস্ত্র, না টানেল, না যুদ্ধের ছাপ। শুধু ছিল রোগী, ডাক্তার আর ধ্বংসের ছায়া।

একই যুক্তিতে কোনো প্রমাণ ছাড়াই তারা গুঁড়িয়ে দিয়েছে স্কুল, মসজিদ। যেন ঘরবাড়ির চেয়ে কথার ওজন বেশি।

আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ নেভ গর্ডন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘একটা ঘর ধ্বংস করার পেছনে হয়তো একটা গল্প দাঁড় করানো যায়। কিন্তু যখন পুরো একটা শহর ধুলোয় মিশে যায়, তখন সেটা যুদ্ধ নয়, সেটাই গণহত্যা।’

এই গণহত্যা যাতে কেউ না দেখে, না জানে তাই গাজায় সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। যারা ভেতরে ছিলেন, একে একে প্রাণ দিয়েছেন। পশ্চিমা গণমাধ্যম অনেকটাই নীরব—কেউ হয়তো চুপ করে আছে, কেউ আবার দখলদারদের কথাই তোতাপাখির মতো বলছে।

তবু সত্য চাপা থাকছে না। আজকের পৃথিবীতে প্রতিটি ফেসবুক ব্যবহারকারীও দেখতে পাচ্ছে, একটি জাতির ঘরবাড়ি কেমন করে দিনে দিনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, বুলডোজারের চাকায় ঘুরছে ইতিহাস। তাই প্রশ্নটা উঠবেই, যারা বুলডোজারের চালকের আসনে বসেছিল, তারা কি জানত তারা কেবল একটা দেওয়াল ভাংছে না, তারা একটি জাতির অস্তিত্ব, সংস্কৃতি আর স্মৃতিকে চিরতরে মুছে দিচ্ছে?

তথ্যসূত্র: পার্সটুডে।