ঢাকা বুধবার, ১৬ জুলাই, ২০২৫

তাইওয়ান নিয়ে উত্তেজনায় নিরাপত্তা শঙ্কার কথা জানাল জাপান

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ১৫, ২০২৫, ০৭:৪৫ পিএম
জাপানের সামরিক বাহিনী। ছবি- সংগৃহীত

দ্বীপদেশ তাইওয়ানকে ঘিরে ফের উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। সম্প্রতি তাইওয়ান প্রণালিতে ঘন ঘন সামরিক গোয়েন্দা কার্যক্রম বৃদ্ধি করেছে বেইজিং। তাইপেকে যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্রসহ ভারী সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ বৃদ্ধি করেছে ওয়াশিংটন। এদিকে তাইওয়ানে চীনের সম্ভাব্য হামলার হুমকির মধ্যেই মিত্র রাষ্ট্র জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে চাপ দিচ্ছে পেন্টাগন।

এমন পরিস্থিতিতে চীন ও আমেরিকার মধ্যেকার টানাপোড়েনে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে জাপান। বলেছে, পৃথিবী সংকটের এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। গত সপ্তাহে দেশটির বার্ষিক প্রতিরক্ষা প্রতিবেদনে এ মন্তব্য করে টোকিও। প্রকাশিত শ্বেতপত্রে চীনকে দেশটির সবচেয়ে বড় কৌশলগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করে, ইন্দো-প্যাসিফিক মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতি বিরাট প্রভাব ফেলবে বলে উল্লেখ করা হয়।

একই দিন জাপানের মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রতিবেদনটি অনুমোদিত হয়। প্রতিবেদনে জাপানের আঞ্চলিক নিরাপত্তার কঠোর মূল্যায়নের পাশাপাশি, নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। প্রতিবেদনে চীনকে ‘জাপানের সর্বকালের সবচেয়ে বড় কৌশলগত প্রতিবন্ধকতা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়েছে, বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্য নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, ভবিষ্যতে দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। বিশেষ করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে প্রতিযোগিতা তীব্রতর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

জাপানের একটি শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, চীনের সামরিক বাহিনী জাপানের আশপাশের এলাকায় তাদের কার্যক্রম বাড়াচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ ঘিরে থাকা পূর্ব চীন সাগর, জাপান সাগর এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের অঞ্চল। এমনকি তারা তথাকথিত প্রথম দ্বীপমালার বাইরে গিয়ে দ্বিতীয় দ্বীপমালাতেও তৎপরতা চালাচ্ছে।

শ্বেতপত্রে বেশ কিছু সাম্প্রতিক ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, মে মাসে চীনা কোস্টগার্ডের একটি হেলিকপ্টার জাপান-নিয়ন্ত্রিত কিন্তু চীনা দাবিকৃত সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি জাপানের আকাশসীমায় উড়ে যায়। এছাড়া গত আগস্টে প্রথমবারের মতো একটি চীনা সামরিক বিমান জাপানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে, এবং সেপ্টেম্বরে চীনের একটি বিমানবাহী রণতরী জাপানের আঞ্চলিক জলসীমার কাছাকাছি চলে আসে।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বেইজিং আরও আক্রমণাত্মক ভঙ্গি নিয়েছে। গত মাসে চীন একসঙ্গে দুটি সক্রিয় বিমানবাহী রণতরী পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে পাঠিয়েছে। আর সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তারা একাধিকবার জাপানি বিমানের কাছাকাছি যুদ্ধবিমান পাঠিয়েছে, যা টোকিওর মতে সম্ভাব্য সংঘর্ষের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।

পূর্ব এশিয়ায় ইউক্রেন যুদ্ধের মতো একটি ‘গুরুতর পরিস্থিতি’ ঘটতে পারে—এ সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এতে চীনের সম্ভাব্য তাইওয়ান আক্রমণের আশঙ্কা স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।

টোকিও-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম জাপান টাইমস বলেছে, “যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে সামরিকভাবে সমর্থনের ব্যাপারে তার অবস্থান ক্রমাগত স্পষ্ট করছে। অপরদিকে, চীন তাইওয়ানকে নিজের ‘মূল স্বার্থের কেন্দ্রবিন্দু’ মনে করে এবং তাই এই বিষয়ে তারা আপস করতে রাজি নয়। ফলে এই ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সংঘর্ষ আরও তীব্র হতে পারে।”

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বারবার বলেছিলেন, যদি চীন তাইওয়ানে আক্রমণ করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তার পাশে দাঁড়াবে। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এ বিষয়ে সেভাবে মুখ খোলেননি। যদিও ধারণা করা হচ্ছে, পেন্টাগন এখনো তাইওয়ান নিয়ে সম্ভাব্য মার্কিন-চীন সংঘর্ষে জাপানের ভূমিকা নিয়ে টোকিওকে চাপ দিয়ে যাচ্ছে।

জাপান মনে করে, তাইওয়ানে যেকোনো রকমের সংকট তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও বড় ধরনের হুমকি।

শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, ‘তাইওয়ানকে ঘিরে পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা শুধু জাপানের নিরাপত্তার জন্যই নয়, বরং পুরো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই জাপানকে আরও সতর্কভাবে এই পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যেতে হবে।’

ট্রাম্প তার ক্ষমতার প্রথম মেয়াদে এই প্রতিযোগিতা শুরু করেন এবং দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার প্রথম ছয় মাসেও এই প্রতিযোগিতা অব্যাহত রেখেছেন। এ নিয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা গত ফেব্রুয়ারি মাসে ওয়াশিংটনে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন।

দেশটির শ্বেতপত্রে আরও বলা হয়, দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প ইউক্রেন, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের পলিসি বাস্তবায়নের ইঙ্গিত দেন। ফলে জাপানসহ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিরাটভাবে প্রভাবিত হবে।

প্রতিবেদনটি মূলত গত বছরের এপ্রিল থেকে এ বছরের মার্চ পরযন্ত সূচকগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয় বলে জানান জাপানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেন নাকাতানি। এ সময় জাপানসহ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পলিসি পুরোপুরি পরিষ্কার নয় বলে জানান তিনি।

এছাড়াও, শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, ‘রাশিয়া উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র-সম্পর্কিত প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে পারে এমন ঝুঁকি রয়েছে, যা ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সামরিক ভারসাম্যের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে।’

উত্তর কোরিয়াকে ‘জাপানের নিরাপত্তার জন্য আগের যেকোনো সময়ের চেয়েও গুরুতর এবং আসন্ন হুমকি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে শ্বেতপত্রে। বলা হয়েছে, দেশটির ‘পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সজ্জিত করে জাপানে আক্রমণ করার ক্ষমতা’ রয়েছে।

এই হুমকিগুলো মোকাবেলা করার পাশাপাশি ট্রাম্পের অধীনে মার্কিন নীতি পরিবর্তনের সম্ভাব্য পরিণতি মোকাবেলা করার বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘জাপানকে সমান মনোভাবাপন্ন দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে... যাতে বলপ্রয়োগ বা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে স্থিতাবস্থা পরিবর্তনের একতরফা প্রচেষ্টা মোকাবেলা করা যায়। শুধুমাত্র মিত্রদের সঙ্গেই নয়, বরং যতটা সম্ভব দেশের সঙ্গে সহযোগিতা জোরদার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’