মিশরের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত সিনাই প্রদেশে একটি গণকবর থেকে শত শত মরদেহ সমাহিত থাকার প্রমাণ মিলেছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকার কর্মীরা। প্রদেশটি দখলদার ইসরায়েলের আগ্রাসনের শিকার স্বাধীন রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের সীমান্তঘেঁষা।
সিনাই ফাউন্ডেশন ফর হিউম্যান রাইটস (এসএফএইচআর) জানায়, একটি সামরিক ফাঁড়ির কাছের সমাধিস্থলে মাটির উপর ও মাত্র ৩০ সেন্টিমিটার নিচে চাপা অবস্থায় বহু মরদেহ পাওয়া গেছে। সংস্থাটি গত এক দশক ধরে মিশরীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও ইসলামিক স্টেট (আইএস)-সমর্থিত সন্ত্রাসীদের সংঘাত চলাকালে নিখোঁজ এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছিল। সেই প্রক্রিয়ায় তারা এই গণকবর আবিষ্কার করে।
এসএফএইচআরের নির্বাহী পরিচালক আহমেদ সালেম বলেন, দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এই অনুসন্ধান ‘উত্তর সিনাইতে বলপূর্বক অন্তর্ধান এবং বিচারবহির্ভূত মৃত্যুদণ্ডের বিরল প্রমাণ’ হিসেবে সামনে এসেছে। তার ভাষায়, এই আবিষ্কার কেবল সেনাবাহিনীর লঙ্ঘনের মাত্রাকেই তুলে ধরছে না, বরং সম্পূর্ণ দায়মুক্তির সঙ্গে বেআইনি হত্যাকাণ্ড ও গোপন দাফনের একটি পদ্ধতিগত ধারা প্রকাশ করছে।
যদিও মিশরীয় কর্তৃপক্ষ সিনাইয়ে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি ঘটানোর কথা অস্বীকার করে আসছে, তাদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি আদিবাসীকে উচ্ছেদ করার অভিযোগ রয়েছে। একইসঙ্গে আইএস-বিরোধী অভিযানে কোনো বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটেনি বলেও দাবি করে আসছে তারা।
এসএফএইচআরের সর্বশেষ প্রতিবেদনে আল-আরিশ শহরের দক্ষিণে একটি গণকবরের অবস্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানে একাধিক সামরিক ঘাঁটি, বৃহৎ বালির পরিখা এবং ভারী সামরিক উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। কবরটি মূল সড়ক থেকে মাত্র ৩৫০ মিটার দূরে হলেও, ২০১৩ থেকে ২০২২ সালের সংঘাতকালীন কঠোর অবরোধের কারণে এলাকা দীর্ঘদিন সাধারণ মানুষের চোখের আড়ালে ছিল।
সংস্থাটি জানায়, সেনাপন্থী মিলিশিয়াদের দুই সদস্য প্রাথমিকভাবে কবরের তথ্য দিলেও পরবর্তীতে তাদের গবেষকরা সরেজমিন অনুসন্ধানে যান। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর ও ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দুটি গর্ত আবিষ্কৃত হয়। এর মধ্যে একটিতে সেনা উপস্থিতির কারণে প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি, তবে মরদেহের অবশিষ্টাংশ পৃষ্ঠ থেকে দৃশ্যমান ছিল। অন্য গর্তে খনন করলে আরও মরদেহ পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে, অতীতে বন্যার কারণে মরদেহগুলো উপরে চলে আসে।
এসএফএইচআরের শেয়ার করা ভিডিওতে মরদেহ ও অস্থি স্পষ্টভাবে দেখা যায়। ফরেনসিক আর্কিটেকচার নামের লন্ডনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা স্যাটেলাইট চিত্র ও ছবি বিশ্লেষণ করে অন্তত ৩৬টি খুলি শনাক্ত করেছে। তবে এসএফএইচআরের গবেষকদের হিসাব মতে সেখানে ৩০০’র বেশি মরদেহ থাকতে পারে।
এসএফএইচআরের এক সদস্য বলেন, ‘এত মরদেহ একসঙ্গে দেখে আমরা হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। হয়তো এরা একসময় আমাদের পাশেই হাঁটত, এখন তারা কঙ্কাল হয়ে মাটির নিচে পড়ে আছে। দৃশ্যটি ছিল ভয়াবহ।’
গবেষকরা জানান, মরদেহগুলো স্থানীয় রীতিনীতি মানা ছাড়াই অগোছালোভাবে দাফন করা হয়েছে। অনেকে হত্যার সময়কার পোশাকেই ছিলেন। কয়েকজনের চোখ বাঁধা অবস্থায় পাওয়া গেছে। কবরস্থানে কোনো সামরিক পোশাক বা সরঞ্জামের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক তথ্যদাতাদের মতে, এখানে আটক হওয়ার পরপরই নিহতদের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে আটক থাকা ব্যক্তিদেরও কবর দেওয়া হয়েছে। তারা সবাই সন্ত্রাসী ছিলেন না, তবে সহযোগিতার সন্দেহে প্রমাণ ছাড়াই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। আরেক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, তিনি নিজ চোখে দেখেছেন ১৫ জনকে হত্যা করা হয় এবং সৈন্যরা তাদের মরদেহের পাশে অস্ত্র রেখে পরদিন দাবি করে যে সংঘর্ষে ১৫ জন সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে।
২০১৬ সালে স্বামী ও ভাইদের গ্রেপ্তার হওয়া এক নারী জানান, নয় বছর পার হলেও পরিবারের সদস্যদের খোঁজ পাননি। তিনি বলেন, ‘আমরা ভয়ের মধ্যে বাস করছি। নয় বছর ধরে কোনো খবর পাইনি। সামরিক বাহিনীর বিবৃতিতে যখন নিখোঁজদের ছবি দেখতে পাই, তখন আতঙ্কে থাকি।’
তিনি আরও বলেন, পরিবারটি সাধারণ বেসামরিক। পুরুষ সদস্যরা হয় গ্রেপ্তার হয়েছেন বা পালিয়ে গেছেন। জীবিকার জন্য নারীরা রুটি বেক করে বিক্রি করেন। তার একটি ছেলে আছে, যার জন্ম হয় স্বামীর গ্রেপ্তারের সময়। তিনি আরও এক ভাইয়ের মেয়ের দেখাশোনা করছেন, কারণ তার মা মারা গিয়েছিলেন বাবার গ্রেপ্তারের আগে।
অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে ওই নারী বলেন, ‘আমার ছেলে কেবল তার বাবার ছবি চেনে। এটা হৃদয়বিদারক। গত নয় বছরে এমন একটি রাতও যায়নি যেদিন আমি কান্না ছাড়া ঘুমাতে পেরেছি।’