ঢাকা শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর, ২০২৫

রাজশাহীতে এইচআইভির প্রকোপ

১০ মাসে আক্রান্ত ২৮, একজনের মৃত্যু

জনাব আলী, রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশিত: নভেম্বর ৬, ২০২৫, ১১:২৫ পিএম
  • আক্রান্তদের মধ্যে তৃতীয় লিঙ্গের একজন
  • চলতি বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ২৩৪৬ জনের নমুনা পরীক্ষা
  • আক্রান্তের অধিকাংশ ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সি তরুণ-তরুণী
  • যৌনকর্মীর চেয়ে সমকামিতায় বেশি ছড়িয়েছে এইচআইভি
  • রামেকে প্রতিদিন গড়ে ১০-১৫ জন এইচআইভি পরীক্ষা করেন
  • রামেকে টেস্ট ও কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা থাকলেও পাওয়া যায় না ওষুধ
  • গত ৬ বছরে রাজশাহী জেলায় আক্রান্ত ৯৩, মৃত্যু আটজনের

রাজশাহীতে ১০ মাসে এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের একজনসহ ২৮ নারী-পুরুষ। এই সময়ের মধ্যে এইডসে মারাও গেছেন একজন। আক্রান্তের বেশির ভাগ ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সি তরুণ-তরুণী। উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি চরম উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। কিন্তু শঙ্কা থাকলেও নেই সতর্কতা। গত পাঁচ বছরের হিসাব বলছে, ক্রমান্বয়ে বেড়েছে এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা। চলতি বছর সেটা মারাত্মক গতি পেয়েছে।

চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজশাহীতে যৌনকর্মীর চেয়ে সমকামিতায় বেশি ছড়িয়েছে এইচআইভি। গত ছয় বছরে এইচআইভিতে আক্রান্তের সংখ্যা দঁড়িয়েছে ৯৩। এ সময় এইডসে মারা গেছেন আটজন। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের এইচটিসি সেন্টারে (টেস্টিং অ্যান্ড কাউন্সেলিং সেন্টার) প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১৫ জন এইচআইভি নমুনা পরীক্ষার জন্য আসেন। যারা পজিটিভ হন, তাদের বিভিন্ন কাউন্সিলিং করা হয়। তাদের বোঝানো হয় যে, এই রোগ পুরোপুরি ভালো না হলেও নিয়ন্ত্রণযোগ্য। নিয়মিত চিকিৎসা নিলে ভালো থাকা যায়। তবে আশার কথা হলো, রামেক হাসপাতালের আইটডোরে এইচটিসি সেন্টার চালু রয়েছে। সেখানে এইচআইভির জীবাণু পরীক্ষা করা হয়। খুব অল্প সময়ে দেওয়া হয় রেজাল্ট। এখানে কাউন্সেলিং করা হলেও নেই ওষুধের ব্যবস্থা।

রাজশাহী বিভাগে অন্য সব জেলায় পজিটিভ রোগীর চিকিৎসা নিতে হয় বগুড়া শহিদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) থেকে। সেখানে বিনা মূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ দেওয়া হয়। কিন্তু রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওষুধের ব্যবস্থা নেই।

রামেক হাসপাতালের এইচটিসি সেন্টার সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে ৭৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। বছরটিতে একজনও পজিটিভ ছিল না। তবে পরের বছর ২০২০ সালে এসে দুজনের শরীরে এইচআইভি জীবাণু পাওয়া যায়। চলতি বছর ৩২১ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল। ২০২১ সালে ১ হাজার ৫২৭ জনের নমুনা পরীক্ষায় আটজন এইচআইভি পজিটিভ হন। সে বছর একজনের মৃত্যু হয়। তবে তিনি এইচআইভি পজিটিভ হওয়ার পরে চিকিৎসার জন্য সময় পাননি। চিকিৎসা শুরুর কিছুদিন পর তিনি মারা যান।

২০২২ সালে ২ হাজার ৩১ জনের মধ্যে আটজন এইচআইভি পজিটিভ হন। এ বছর একজনের মৃত্যু হয়। মৃত রোগী একই বছরে এইচআইভি পজিটিভ হয়েছিলেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনিও মারা যান। ২০২৩ সালে ২ হাজার ৩৬০ জনের নমুনা পরীক্ষায় ২৪ জন হন পজিটিভ। ওই বছর এইডসে সর্বোচ্চ ৩ জনের মৃত্যু হয়। ২০২৪ সালে ৩ হাজার ৫৩২ জনের মধ্যে ২৭ জন এইচআইভি পজেটিভ পাওয়া যায়। এই বছরও তিনজনের মৃত্যু হয়। সর্বশেষ ২০২৫ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ২ হাজার ৩৪৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করে এই বছরের সর্বোচ্চ ২৮ জন এইচআইভি পজেটিভ হয়েছেন। মার্চ মাসে একজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে।

হাসপাতালের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সর্বশেষ দুই বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সমকামিতার মাধ্যমে এইচআইভি আক্রান্তের হার বেশি। তার পরে রয়েছে সেক্স ওয়ার্কার (যৌনকর্মী)। ২০২৪ সালে ২৭ জন এইচআইভি পজিটিভের মধ্যে সমকামিতার মাধ্যমে এইচআইভি ছড়িয়েছে ১৬ জনের শরীরে। আর সেক্স ওয়ার্কার ১০ জন পজিটিভ। এ ছাড়া রক্ত থেকে সংক্রমিত হয়েছেন একজন। এ বছর ২৩ জন পুরুষ ও চারজন নারী এইচআইভি পজিটিভ হন। একই বছরের ৩ হাজার ৫৩২ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ২৩১ জন পুরুষ, ২ হাজার ১৫০ জন নারী ও ১৫১ জন হিজড়া।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এইচআইভি পজিটিভ একজন জানান, পজিটিভ হয়েছে অনেক দিন হলো। নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। তবে রাজশাহী হাসপাতালে এইচআইভির ওষুধ পাওয়া যায় না। এখানে শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। পজিটিভ হলে যেতে হয় বগুড়ায়। সেখানে বিনা মূল্যে ওষুধ পাওয়া যায়। তবে সেখানে যাওয়া সময়সাপেক্ষ। রাজশাহী হাসপাতালে ওষুধ পাওয়া গেলে এই রোগীদের উপকার হবে।

রামেক হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা জনান, এখানে এইচটিসি সেন্টার চালু রয়েছে। এখানে শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। ওষুধ পাওয়া যায় না। এইচআইভির ওষুধ বগুড়ার শজিমেক থেকে নিতে হয়। রামেক হাসপাতালেও এআরটি সেন্টার চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে কথা হয়েছে। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে চালু হবে এআরটি সেন্টার। এটি চালু হলে রোগীদের আর বগুড়ায় গিয়ে ওষুধ নিতে হবে না। রাজশাহী ও এর আশপাশের জেলার রোগীরা রামেক হাসপাতাল থেকে ওষুধ নিতে পারবেন।

রামেক হাসপাতালের এইচটিসি সেন্টারের কাউন্সিলর রেজাউল করিম বলেন, রামেক হাসপাতালে এইচআইভি টেস্ট শুরু হয় ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে। তবে কার্যক্রম শুরু হয় একই বছরের আগস্টে। ছয় বছরে হাসপাতালে ১২ হাজার ৪৬৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে পজিটিভ হয়েছেন ৯৩ জন। আর মারা গেছেন আটজন এইচআইভি পজিটিভ রোগী। আর হাসপাতালের বাইরে আরও ৩০ জন এইচআইভি পজিটিভ রয়েছেন (এনজিও ও বেসরকারি সংস্থার তথ্য)। যারা রাজশাহী জেলার। তবে তারা হাসপাতালে না এসে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

তিনি উল্লেখ করেন, আক্রান্তরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তারা কখনো কখনো আত্মহত্যার কথাও ভাবেন। আবার ভাবেন এই রোগের জীবাণু অন্যকেও ছড়িয়ে দেওয়ার কথা। এই প্রবণতাটা তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ করে। তাদের নিয়মিত এইচটিসি সেন্টারে আসতে বলা হয়। আমরা তাদের সুস্থ থাকার লক্ষ্যে কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে পরামর্শ দিয়ে থাকি।

রামেক হাসপাতালের এইচটিসি সেন্টারের ফোকাল পার্সন ডা. ইবরাহীম মো. শরফ বলেন, ‘এইচআইভি সংক্রমণ ছড়ানোর অন্যতম প্রধান উপায় হচ্ছে নারী ও পুরুষের মধ্যে অরক্ষিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ যৌনমিলন। যেমনÑ নারী-পুরুষে অথবা পুরুষে-পুরুষে উভয় ধরনের যৌনমিলনের মাধ্যমেই এইচআইভি ছড়ায়। এ ছাড়া, মা থেকে শিশুর এইচআইভি সংক্রমণ হয়ে থাকে। গর্ভাবস্থায়, জন্মগ্রহণের সময় এবং জন্মের পরে মায়ের বুকের দুধের মাধ্যমে।’ এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি।