ঢাকা সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

এবার ইরাকের দিকে চোখ নেতানিয়াহুর, পাল্টা হুঁশিয়ারি বাগদাদের

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৫, ০২:১৩ পিএম
জাতিসংঘে নেতানিয়াহুর ভাষণ। ছবি- সংগৃহীত

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে বিশ্বনেতারা যখন গাজায় ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানাচ্ছিলেন, তখন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু তার ভাষণের শুরুতেই ইরান ও ‘আঞ্চলিক প্রতিরোধ আন্দোলন’র বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন। ভাষণে আরও এক ধাপ এগিয়ে ইরাকি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধেও সরাসরি হামলার হুমকি দেন এবং প্রকাশ্যে তাদের লক্ষ্যবস্তু করার ঘোষণা করেন।

এই হুমকিকে ইরাকের সার্বভৌমত্বের স্পষ্ট লঙ্ঘন হিসেবে দেখছে বাগদাদ। ইরাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফুয়াদ হুসেইন সতর্ক করে বলেছেন, ‘ইরাকের যেকোনো নাগরিকের ওপর হামলা গোটা জাতির ওপর আক্রমণ হিসেবে বিবেচিত হবে।’

ইরানের বার্তাসংস্থা ‘মেহের’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিশ্লেষক মোহাম্মদ বাঘের হেইদারি বলেন, নেতানিয়াহুর এ ধরনের বক্তব্য নতুন নয়। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বহু বছর ধরে ইরাকের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে হামলার হুমকি দিয়ে আসছেন। প্রায় এক বছর আগে একই ধরনের একটি ঘটনার সময় ইরাক জাতিসংঘে অভিযোগ দায়ের করে, যার ফলে আক্রমণ প্রতিহত হয়।

ইসরায়েলের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা
বিশ্লেষক মোহাম্মদ বাঘের হেইদারি ব্যাখ্যা করেন, ইসরায়েলের ইরাকসংক্রান্ত নীতির দুটি দিক রয়েছে। একটি আঞ্চলিক, অন্যটি ইরাকের অভ্যন্তরীণ। আঞ্চলিকভাবে, ইসরায়েল ইরাককে আলাদা করে দেখে না। তারা গোটা অঞ্চলজুড়ে প্রভাব বিস্তার করতে ‘গ্রেটার মিডল ইস্ট’ প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং কথিত ‘ডেভিড করিডোর’ গঠনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই করিডোর সিরিয়ার একটি বড় অংশ থেকে শুরু করে ইরাকের এরবিল ও সুলাইমানিয়া হয়ে পশ্চিমাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। ইসরায়েলি নেতারা প্রকাশ্যে এ বিষয়ে কথা বলছেন।

আরেকটি দিক হলো, ইসরায়েল শুরু থেকেই বলেছে তারা সাতটি ফ্রন্টে সামরিকভাবে সক্রিয় হবে। এর মধ্যে রয়েছে—গাজা, পশ্চিম তীর, লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরান এবং ইরাক। এই সাতটির মধ্যে ছয়টিতে তারা ইতোমধ্যেই সামরিক অভিযান চালিয়েছে, একমাত্র বাকি ছিল ইরাক, যেটিতে ঢোকার ঘোষণা তারা আগেই দিয়েছিল।

ইরাকের দুর্বলতা
হেইদারি বলেন, ইরাকি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো একক সংগঠন নয়; বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত। যুক্তরাষ্ট্র ইরাককে কখনো কার্যকর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (যেমন এস-৩০০ বা এস-৪০০) গড়ে তুলতে দেয়নি। ইসরায়েলের সঙ্গে ইরাকের কোনো স্থলসীমান্তও নেই, তাই আক্রমণ হলে তা মূলত বিমান হামলার মাধ্যমেই হবে। আগের এক যুদ্ধে বাগদাদের রাডার সিস্টেম পর্যন্ত গোপনে টার্গেট করা হয়েছিল, ফলে আকাশপথে হামলার ক্ষেত্রে ইরাকের দুর্বলতা স্পষ্ট।

আমেরিকান বাহিনীর প্রত্যাহার ও অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ভিক্টোরিয়া ও আইন আল-আসাদ ঘাঁটি খালি করে কুর্দিস্তানের হারির ঘাঁটিতে স্থানান্তর করেছে। এই প্রত্যাহার পরিকল্পনা আগে থেকেই ২০২৫ সালে কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও, এখনই তা করা হয়েছে, যা নতুন অস্থিতিশীলতার ইঙ্গিত বহন করে। অতীতেও দেখা গেছে, যেখানে মার্কিন বাহিনী পিছু হটে সেখানে অল্প সময়ের মধ্যেই নিরাপত্তা অস্থিরতা শুরু হয়, যেমনটি আফগানিস্তানে হয়েছিল। ফলে ইরাকে অস্থিরতার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হচ্ছে বলে ধারণা করা যায়।

এরই মধ্যে ইরাকজুড়ে আইএস-সদৃশ একটি নতুন গোষ্ঠী কার্যক্রম শুরু করেছে, যদিও তারা এখনো প্রকাশ্যে সশস্ত্র হয়নি। দুই সপ্তাহ আগে বাগদাদে একজন ধর্মীয় নেতাকে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। এসবই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ইরাকে নতুন এক অস্থির সময়ের সূচনা হতে পারে। 

প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর ভূমিকা ও চুক্তি
এক বছর আগে ইরাকি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল-সুদানির একটি সমঝোতা হয়। গাজায় ইসরায়েলি হামলার সময় এই গোষ্ঠীগুলো ‘ইসলামিক রেজিস্ট্যান্স অব ইরাক’ নামে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ড্রোন ও মিসাইল দিয়ে ইসরায়েলকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিল। কিছু আক্রমণ ব্যর্থ হলেও কিছু সফলভাবে পৌঁছেছিল। এতে ইসরায়েলের হুমকি আরও বেড়ে যায় এবং ইরাক জাতিসংঘে অভিযোগ দায়ের করে। পরে এক চুক্তির মাধ্যমে কম সময়ের জন্য হলেও হলেও শান্তি ফিরে আসে।

সেই চুক্তির মূল কথা ছিল, প্রতিরোধ গোষ্ঠী আপাতত হামলা চালাবে না। তবে যদি ইসরায়েল ইরাককে আক্রমণ করে, তাহলে সরকার কূটনৈতিকভাবে প্রতিবাদ করবে এবং এরপর প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো আমেরিকান স্বার্থ ও ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানবে। তাই হেইদারির মতে, এই হুমকিতে ইরাকি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে, এমন সম্ভাবনা কম।

নির্বাচনের প্রাক্কালে হুমকির তাৎপর্য
বর্তমানে ইরাকে জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। রাজনৈতিক উত্তেজনা ও দলগুলোর মধ্যে সংঘাত বেড়ে গেছে। বিশ্লেষকদের মতে, সমন্বয় ফ্রেমওয়ার্ক জোট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, যা ইসরায়েলের জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে। তাই নির্বাচনের আগে ইসরায়েলি হুমকি আসছে নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করার কৌশল হিসেবেও। যদি নির্বাচন ব্যাহত হয়, বর্তমান সরকার কার্যত সীমিত ক্ষমতাসম্পন্ন অন্তর্বর্তী সরকারে পরিণত হবে, যা দেশে নতুন অস্থিতিশীলতার জন্ম দিতে পারে।

এ ছাড়া, প্রাক্তন বাথ পার্টির সদস্যদেরও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে, যা ইরাকের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। যদি নির্বাচন ব্যাহত হয়, তাহলে আল-সুদানির সরকার কার্যকরভাবে একটি তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনে পরিণত হবে যার কর্তৃত্ব সীমিত থাকবে যতক্ষণ না নতুন নির্বাচনের নিষ্পত্তি হয়।

এসব ইঙ্গিত স্পষ্ট করে যে, ইরাকি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোই কেবল লক্ষ্যবস্তু নয়, বরং সমগ্র ইরাকের নিরাপত্তা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রাকৃতিক সম্পদ সমন্বিতভাবে হামলার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছে। অথচ গত এক থেকে দুই বছর ধরে দেশটি তুলনামূলক অভূতপূর্ব শান্তি উপভোগ করছিল। এখন মনে হচ্ছে, এই স্থিতিশীলতা নষ্ট করে নতুন অস্থিরতার সূচনা করার জন্য একটি পরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।