সুদানের এল-ফাশারে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) সমর্থিত আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) হামলা চালিয়ে হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিক হত্যা করার একদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের উপ-সচিব জ্যাকব হেলবার্গ আবুধাবিতে পৌঁছান।
এসে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এক পোস্টে লিখেছেন, ‘আমেরিকার অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং প্রযুক্তিগত নেতৃত্বকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সংযুক্ত আরব আমিরাত একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার। আব্রাহাম চুক্তির প্রতিষ্ঠাতা স্বাক্ষরকারী হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাত আঞ্চলিক নেতৃত্বকে শান্তিপূর্ণ সমৃদ্ধির জন্য একটি শক্তি হিসেবে প্রদর্শন করছে।’
আব্রাহাম চুক্তি ও ইসরায়েল-ইউএই সম্পর্ক
২০২০ সালে মার্কিন মধ্যস্থতায় ইসরায়েল এবং কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত আব্রাহাম চুক্তি। এর মাধ্যমে মূলত ইসরায়েল-সংযুক্ত আরব আমিরাতের কৌশলগত অংশীদারিত্বকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়। যদিও গাজায় সংঘটিত ঘটনার পর ইউএই মাঝে মাঝে সমালোচনামূলক অবস্থান নিয়েছে, তবুও দু’দেশের মধ্যে বড় ধরনের টানাপোড়েন দেখা যায়নি।
একজন আমিরাতের শিক্ষাবিদ দ্য নিউ আরবকে বলেছেন, ‘দুবাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গি হলো যুদ্ধ অনেক দীর্ঘ হয়ে গেছে, তবে কৌশলগত সুবিধাগুলো এখনো অসুবিধার চেয়ে বেশি।’
তেল আবিবের বেন-গুরিয়ন বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক বিমান পরিষেবা বন্ধ থাকলেও, আমিরাতের বিমান সংস্থাগুলো যুদ্ধকালীন সময়ে কার্যকরভাবে ভ্রমণের সুযোগ দিয়ে চলেছে। দুই দেশের মধ্যে ২০২০ সাল থেকে অর্থ, কৃষি ও জ্বালানি ক্ষেত্রে সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। ২০২৪ সালে দুই দেশের বাণিজ্য প্রায় ৩.২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
সামরিক ও গোয়েন্দা সহযোগিতা
ইউএই-ইসরায়েল সহযোগিতার সবচেয়ে গতিশীল ক্ষেত্র হলো অস্ত্র বিক্রয়, গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি ও নজরদারি। গাজায় ফিলিস্তিনিদের দমন এবং সুদানের ‘লিবিয়া-কল্পকাহিনী’ এই সহযোগিতার উদাহরণ।
সুদানী অনুসন্ধানী সাংবাদিক ইয়াদ হুশাম বলেছেন, ‘ইউএই লজিস্টিক ও আর্থিক চ্যানেলের মাধ্যমে আরএসএফকে সহায়তা দেয়, আর ইসরায়েল প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা দক্ষতার মাধ্যমে ইউএইকে শক্তিশালী করছে।’
২০২২ সালে ইসরায়েলের বড় অস্ত্র প্রস্তুতকারক এলবিট সিস্টেমস ইউএইতে একটি সহায়ক সংস্থা খুলে ৫৩ মিলিয়ন ডলারের এভিওনিক্স চুক্তি সম্পন্ন করেছে। এরপর থেকে ইউএই বারাক ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করেছে এবং মানবহীন নৌযানসহ যৌথ সামরিক প্রযুক্তি উন্মোচন করেছে।
ইউএই ও ইসরায়েল যৌথভাবে ‘ক্রিস্টাল বল’ নামে একটি গোয়েন্দা-শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম পরিচালনা করছে। ‘ব্ল্যাক ওয়াল গ্লোবাল’ এর মতো উদ্যোগগুলি সংবেদনশীল প্রযুক্তি স্থানান্তর সহজ করছে।
গাজা ও আফ্রিকায় স্থলভাগে সহযোগিতা
গাজায় পূর্ব রাফাহ ধ্বংস এবং প্রায় ৬ লাখ ফিলিস্তিনি আটকে রাখার পরিকল্পনায় ইউএই জড়িত। আফ্রিকায় ইসরায়েলি সহায়তায় ইউএই হর্ন ও ইয়েমেন জুড়ে সামরিক ও গোয়েন্দা ঘাঁটি স্থাপন করেছে। ইয়েমেনের গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ ও রাডার সিস্টেমে ইসরায়েলি মোতায়েন ইউএইকে হুথি আক্রমণ পর্যবেক্ষণ ও প্রতিহত করতে সক্ষম করছে।
সুদানকে কৌশলগত বাফার হিসেবে ব্যবহার
ইসরায়েলের জন্য সুদান শুধু একটি গৌণ যুদ্ধক্ষেত্র নয়, বরং একটি কৌশলগত বাফার। ইউএই এবং আরএসএফের মাধ্যমে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক নিরাপত্তার বাগাড়ম্বরে সম্প্রসারণের সুযোগ পাচ্ছে। চলতি বছরের আগস্টে ইসরায়েলি সূত্র জানিয়েছে, লোহিত সাগরে সামরিক উপস্থিতি বৈধ করার জন্য সুদানের যুদ্ধকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
আরএসএফ প্রাক্তন ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তা তাল দিলিয়ানের সঙ্গে যুক্ত বিমানে উন্নত নজরদারি সরঞ্জাম ও ইসরায়েলি কামান ব্যবহার করেছে। এছাড়াও, ইউএই ওয়াশিংটনে ইসরায়েলপন্থি গোষ্ঠীগুলোতে লবিং প্রসারিত করছে।
মানবিক আইনের লঙ্ঘন
এল-ফাশারের পতনের পর ইউএই আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়ে। প্রচার ও বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা তীব্র হয়েছে, ধারণা করা হচ্ছে সেখানে ইউএই কর্মকর্তা ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা জড়িত।
আরএসএফ কর্মকর্তা ইউসুফ এজ্জাত সুদানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধকে ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি লড়াইয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
নটিংহ্যাম ‘ল’ স্কুলের আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের সিনিয়র লেকচারার লুইজি ড্যানিয়েল বলেন, ‘আরএসএফও সম্মিলিত শাস্তিকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ইসরায়েলের ভাষা গ্রহণ করছে। গাজায় পুরো এলাকা বা শিবিরকে ‘সামরিক এলাকা’ ঘোষণা করা বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করার স্পষ্ট প্রচেষ্টা।’
ডক্টরস ফর হিউম্যান রাইটসের ওসমান মেক্কি বলেন, ‘ইসরায়েলের দায়মুক্তি আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের প্রয়োগকে ক্ষয় করছে, যা আরএসএফের মতো গোষ্ঠীগুলোকেও কাজে লাগাচ্ছে। শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর দায়মুক্তি সশস্ত্র গোষ্ঠীকে শেখাচ্ছে যে আন্তর্জাতিক আইনকে রাজনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক কৌশলে এড়ানো যায়।’
সূত্র: দ্য নিউ আরব

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন