শুক্রবার, ২০ জুন, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: জুন ২০, ২০২৫, ০৫:১২ এএম

গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি, দেশজুড়ে তীব্র সংকট

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: জুন ২০, ২০২৫, ০৫:১২ এএম

গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি, দেশজুড়ে তীব্র সংকট

বৈরী আবহাওয়ার কারণে কক্সবাজারের মহেশখালীর গভীর সমুদ্রে অবস্থিত টার্মিনাল থেকে এলএনজি সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে চট্টগ্রাম, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কমে গেছে গ্যাসের চাপ। বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত দুই এলএনজি টার্মিনাল থেকে  ১১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করার সক্ষমতা থাকলেও দৈনিক গড়ে ৮০-৯০ ঘনফুট সরবরাহ করা হয়।

পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, গত সোমবারও দেওয়া হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু সাগর উত্তাল থাকায় গত মঙ্গলবার থেকে টার্মিনালগুলোতে আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)’র দুটি কার্গো থেকে গ্যাস আনলোড করা যাচ্ছে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে টার্মিনালে মজুত এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশন করে লাইনে গ্যাস দেওয়া হচ্ছে।

এতে মঙ্গলবার রাত থেকেই সরবরাহ কমতে শুরু করেছে। বুধবার সন্ধ্যায় সরবরাহ কমে ২০ কোটি ঘনফুটে নেমে এসেছে। এর ফলে দেশজুড়ে তৈরি হয়েছে তীব্র গ্যাস সংকট। রাজধানীসহ দেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চলের আবাসিকের চুলায় জ¦লছে না আগুন। ব্যাহত হচ্ছে শিল্প-কারখানার উৎপাদনও।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) বলছে, দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস খাত চলছে রেশনিং (এক খাতে সরবরাহ কমিয়ে অন্য খাতে দেওয়া) করে। দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে আমদানি করা এবং দেশীয় উৎপাদিত গ্যাস থেকে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। কোনো কারণে সরবরাহ এর চেয়ে কমলেই বেড়ে যায় সংকট। দেশীয় এবং আমদানি উৎস থেকে বর্তমানে সারা দেশে দৈনিক সরবরাহ হচ্ছিল ২৭১ কোটি ঘনফুট গ্যাস। এর মধ্যে দেশীয় গ্যাস উৎস থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে ২০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। বাকিটা আমদানিকৃত এলএনজি থেকে সরবরাহ করা হচ্ছিল। কিন্তু এলএনজি সরবরাহ করতে না পারায় সংকট দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের। ফলে শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি আবাসিক খাতেও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে গ্রাহকদের। 

কবে নাগাদ এ সংকট কাটতে পারে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, গতকাল বৃহস্পতিবার (গতকাল) সকাল থেকে আবহাওয়া কিছুটা অনুকূলে ছিল। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি সরবরাহ বাড়ানো। আশা করছি দুই একদিনের মধ্যে সরবরাহ বাড়বে। 

গত বুধবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে মহেশখালীর গভীর সমুদ্রে অবস্থিত এলএনজি টার্মিনালে এলএনজি কার্গো নোঙর করতে পারছে না। এ কারণে জাতীয় গ্রিডে এলএনজি সরবরাহ ব্যাপকভাবে কমে গেছে। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, এলএনজি সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় কর্ণফুলী গ্যাস ও তিতাস গ্যাস অধিভুক্ত এলাকায় গ্যাসের কম চাপ বিরাজ করছে। আবহাওয়া স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাহাজ যুক্ত করে গ্যাস সরবরাহ শুরু করা হবে।

মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তায় বর্ষার বৃষ্টির তীব্রতা বাড়ছে উপকূলে। শুধু বৃষ্টি নয় উপকূলে বাতাসের গতিবেগও বেশি। এদিকে বাতাসের গতিবেগের সঙ্গে সাগরের ঢেউয়ের কারণে মহেশখালীতে এলএনজি সরবরাহ বন্ধ হয়ে চট্টগ্রামে গ্যাস সংকট দেখা দেয়ে। গত বুধবার দুপুর থেকে নগরীর শিল্পকারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। যা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অব্যাহত ছিল জানিয়ে রূপালী বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রতিনিধি জানান, নগরীতে গ্যাস সরবরাহ প্রায় বন্ধ হওয়ার কথা স্বীকার করেছে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মোহাম্মদ শফিউল আজম খান। তিনি বলেন, মহেশখালীতে এলএনজিবাহী জাহাজ থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। আর এতে চট্টগ্রামে গ্যাসের চাপ কমে গেছে। প্রাথমিকভাবে শিল্পকারখানাগুলোতে গ্যাস বন্ধ হয়ে গেছে এবং পর্যায়ক্রমে আবাসিকেও বন্ধ হতে পারে।

সরবরাহ কমে যাওয়ায় তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে রাজধানীর আবাসিক বাসাবাড়িতেও। মোহাম্মদপুর, মিরপুর, ফার্মগেইট, কলাবাগান, ধানমণ্ডিসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা গ্যাসের চাপ কম থাকার কারণে ঠিকমতো চুলায় রান্না করতে পারছেন না। তাই বিগত সরকারের মতো বর্তমান সরকারকেও এর জন্য দায়ী করে দোষারোপ করছেন তারা। রাজধানীর গোপীবাগ এলাকার বাসিন্দা ঝর্ণা রায় বলেন, সকাল ৯টা চুলায় আধাকেজি চালের ভাত রান্না করার জন্য বসিয়েছিল। গ্যাসের চাপ এত কম যে সেই চাল সিদ্ধ হয়েছে বেলা ১১টা ৩০-এ।

একই রকম অভিযোগ করেন রাজধানীর মগবাজার এলাকার বাসিন্দা ফারজানা বেগমও। তিনি বলেন, আগে দেখতাম শীতকালে গ্যাস সংকট হতো। এখন সারা বছরই হচ্ছে এটা কেমন কথা? তাহলে আগের সরকার আর এখনকার সরকারের মধ্যে পার্থক্য কি? 

কমেছে শিল্প উৎপাদনও: গ্যাস সংকটে দেশের বড় শিল্প কারখানাগুলোতে কমেছে উৎপাদন। বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছে তৈরি পোশাকশিল্প। এই খাতে গড়ে উৎপাদন কমেছে শতকরা ২০-৩০ ভাগ। আবার যারা ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট ব্যবহার করছেন তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। বাজার থেকে চড়া দামে জ্বালানি তেল কিনতে হচ্ছে তাদের। উৎপাদন কমে যাওয়া ও ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানি আয়ে ভাটা পড়বে বলে আশঙ্কা তাদের।

এসব বিষয় নিয়ে বিকেএমইএর সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ফজলে শামীম এহসান বলেন, গত দুই দিনে গ্যাস সংকটের কারণে আমার কারখানায় উৎপাদন ৫০ ভাগের নিচে নেমে এসেছে। কারণ গ্যাস না থাকার কারণে ডায়িং ফ্যাক্টরিগুলো সময়মতো এবং চাহিদামতো ফেব্রিক সরবরাহ করতে পারছে না। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই এখন তার ক্যাপাসিটির ৫০ ভাগের বেশি উৎপাদন করতে পারছে না।

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বার্ষিক ১ দশমিক ৮ থেকে ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন এলএনজি সরবরাহের জন্য ২০১৭ সালে কাতারের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ। ১৫ বছর মেয়াদি এই চুক্তির অধীনে বাংলাদেশ ২০১৮ সাল থেকে কাতার থেকে এলএনজি আমদানি করে আসছে। বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধি এবং সরবরাহের ঘাটতির কারণে বাংলাদেশ কম খরচে জ্বালানির বিকল্প উৎস খুঁজতে শুরু করে সরকার। 

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বার্ষিক ১ দশমিক ৮ থেকে ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন এলএনজি সরবরাহের জন্য ২০১৭ সালে কাতারের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ। ১৫ বছর মেয়াদি এই চুক্তির অধীনে বাংলাদেশ ২০১৮ সাল থেকে কাতার থেকে এলএনজি আমদানি করে আসছে। বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধি এবং সরবরাহের ঘাটতির কারণে বাংলাদেশ কম খরচে জ্বালানির বিকল্প উৎস খুঁজতে শুরু করে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় গত দুই বছর ওমান, ব্রুনাই, সৌদি আরবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে আমদানি। উপরন্তু এলএনজি টার্মিনালের সক্ষমতাও একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

তবে এই সংকট থেকে উত্তরণে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। দেশীয় কূপ খননে জোর দেওয়ার পাশাপাশি আমদানি বাড়াতেও নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল পরিচালনায় বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে স্বীকার করে জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আবহাওয়ার ওপর তো আমাদের কারো হাত নেই। এর আগেও রক্ষণাবেক্ষণের টার্মিনালগুলো বন্ধ করতে হয়েছে। ফলে গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে। তাই আমরা স্থায়ী এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের প্রক্রিয়ার দিকে যাচ্ছি। আশা করছি, এ বছরেই স্থানী এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হবে। সময় এবং ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় এর সুফল ঠিক কবে নাগাদ পাওয়া যাবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে গ্রাহকদের ভোগান্তি কমাতে সরকার অবশ্যই এটি করবে। 

এদিকে স্থায়ী এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পাশাপাশি আমদানি বাড়াতেও সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। বাড়ানো হচ্ছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। প্রতিযোগিতা বাড়াতে অর্থাৎ সর্বনিম্ন দর পেতে আরও ৩৩ কোম্পানির আবেদনের প্রেক্ষিতে আমদানির অনুমোদন দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ফাওজুল কবির খান বলেন, যেহেতু দেশীয় কূপগুলোতে এখনো নতুন করে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না তাই প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে আমাদের আমদানিই করতে হবে। তবে আমরা চেষ্টা করছি, এক্ষেত্রে যেন সর্বনিম্ন দামে পাওয়া যায়। আপনারা জানেন, স্পট মার্কেট বা খোলাবাজার থেকে এলএনজি ক্রয়ে বিগত সরকারের বদান্যতায় ভিটোল, গানভর, এক্সিলারেট এনার্জি, সামিটসহ গুটিকয়েক কোম্পানির হাতে আমদানির প্রক্রিয়া জিম্মি ছিল। আমরা সেই প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে এখন উন্মুক্ত দর প্রস্তাবের মাধ্যমে আমদানিকারকের পরিমাণ বাড়াতে চাইছি। ইতোমধ্যে এলএনজি সরবরাহের জন্য আরামকো, শেল, বিপি’র মতো জ্বালানি খাতের ৩৩টি জায়ান্ট কোম্পানি আবেদন করেছে। উন্মুক্ত দরপত্রের এটাই সবচেয়ে বড় সুবিধা। আমরা আরও উন্মুক্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরবরাহকারীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে আরও খরচ বাঁচাতে চাই।

এসব সংকট মিটাতে দেশীয় কূপগুলোতে খনন কার্যক্রম বাড়ানোর তাগিদ বিশেষজ্ঞদের। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, বতর্মান সরকার বিগত সরকারের আমলে হওয়া গলা পর্যন্ত হওয়া দুর্নীতির খেসারত দিচ্ছে। ইচ্ছে করলেই সেই গোলকধাঁধা থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার তাদের নিজেদের আখের গোছাতে তাদের পছন্দমতো কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানি করত। এবার যেহেতু প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নতুন কোম্পানি আসছে সেহেতু আমদানি করা এলএনজির মূল্য কম হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে বলে আমি মনে করি। আশা করছি, বৈরী আবহাওয়া কয়েকদিনের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু স্থায়ী সমাধান জরুরি। 

Link copied!