দুই বছর পেরিয়ে গেছে। অথচ দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত চোরাচালান ও অবৈধ পাচার ঘটনার একটি কাস্টমসের গুদাম থেকে ৫৫ কেজি স্বর্ণ গায়েব হওয়া এখনো রহস্যময় অন্ধকারে ঢাকা। ঘটনা তদন্তে দুই দফায় কমিটি গঠন করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কমিটি রিপোর্ট জমা দিলেও সংস্থাটি তা প্রকাশ করেনি।
এ ঘটনায় শুধু নন-ক্যাডার একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সামান্য পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া দীর্ঘ প্রায় তিন বছর ধরে গুদামে জমে থাকা স্বর্ণ ইনভেন্টরি ছাড়াই বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়ার মতো গুরুতর দুর্বলতা শনাক্ত হলেও এনবিআরের উচ্চপর্যায়ের কর্তৃপক্ষ অদৃশ্য কারণে বিষয়টি নিয়ে নীরব রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে অর্থপাচারসহ নানা বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিলেও, আলোচিত স্বর্ণ গায়েবের ঘটনায় এনবিআরের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
সূত্র জানায়, ২০২৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা কাস্টম হাউসের সুরক্ষিত গুদাম থেকে ৫৫ কেজি স্বর্ণ গায়েবের ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় তৈরি হয়। জাতীয় সংসদেও বিষয়টি আলোচিত হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটির প্রতিবেদনের পরও আদতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বর্তমান প্রশাসন। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর এনবিআরে আসেন নতুন চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান। আর সেই সঙ্গে ব্যাপক রদবদল আসে সংস্থাটিতে। শুরুতে ঢাকা কাস্টম হাউসের বিষয়টি নিয়ে কিছুটা পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী হওয়ার পর ফের ঝিমিয়ে পড়েছে তদন্ত-পরবর্তী ব্যবস্থা।
আর তদন্ত প্রতিবেদনে বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশ থাকলেও আদতে বিপরীতমুখী ব্যবস্থার অভিযোগ উঠেছে। আদতে যাদের অবহেলায় বিষয়টি ঘটেছে, তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো প্রাইজ পোস্টিং করা হয়েছে সেসব কর্মকর্তাকে। এ ছাড়া এনবিআরের গঠিত উচ্চ পর্যায়ে গঠিত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন পাশ কাটিয়ে যাওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। এতে ঢাকা কাস্টম হাউসে শীর্ষ দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের অবহেলার শাস্তি নিচের পদের কর্মকর্তাদের ওপর পড়ার আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
সূত্র আরও জানায়, এনবিআরের তৎকালীন শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য ফারজানা আফরোজকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে। এই কমিটি ২০২৩ সালের ২৬ নভেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। বিস্তারিত পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন দাখিল করলেও আদতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি এনবিআরের তৎকালীন প্রশাসন। ঢাকা কাস্টম হাউসে জমার ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরিদর্শন রিপোর্ট থেকে শুরু করে গুদাম পরিদর্শনে ছিল ঢিলেঢালা কার্যক্রম। এমনকি ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সালের নভেম্বরের আগ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকে স্থায়ীভাবে স্বর্ণ জমা দেওয়া হয়নি। যে কারণে গুদামে স্বর্ণ থেকে শুরু করে মূল্যবান জিনিসের স্তূপ তৈরি হয়। এ ছাড়া কাস্টম হাউসে স্বর্ণ গায়েবের ঘটনা সামনে আসার আগ পর্যন্ত ইনভেন্ট্রি কার্যক্রম ছিল না।
শুধু স্টক হিসাব করে কিছু স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়েছে। গুদাম কর্মকর্তার বাইরেও কিছু দপ্তরের দায়িত্বে ছিল চরম অবহেলা। যার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে বলেও মনে করে সংশ্লিষ্ট সূত্র। এ ছাড়া তদন্ত প্রতিবেদনেও এনবিআরের আদেশ জারির পরও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গুদাম নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে অবহেলার বিষয়টিও উঠে এসেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি উচ্চ নিরাপত্তার গুদাম থেকে ৫৫ কেজি স্বর্ণ গায়েব হওয়া শুধু অব্যবস্থাপনা নয়, এটি গভীর দুর্নীতি ও জবাবদিহির অভাবের স্পষ্ট উদাহরণ। দুই বছর পার হলেও এর সুরাহা না হওয়া প্রমাণ করে, এর পেছনে প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশ আছে। জনগণ জানতে চায় এত বড় অঙ্কের রাষ্ট্রীয় সম্পদ উধাও হলো, অথচ এর কোনো দায় কেউ নিল না কেন?’
তিনি আরও বলেন, ‘এই ঘটনার স্বচ্ছ তদন্ত না হলে পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে। এতে দেশের ভাবমূর্তি যেমন ক্ষুণœ হবে, তেমনি সাধারণ মানুষের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।’
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ৫৫ কেজি স্বর্ণ উধাওয়ের বিষয়টি সামনে আসার পর বিমানবন্দর থানায় মামলা করে ঢাকা কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ। প্রাথমিকভাবে চার গুদাম কর্মকর্তাকে আটক করে পুলিশ। পরবর্তী সময়ে মামলা যায় ডিবিতে। সর্বশেষ মামলাটি পুলিশ ইনভেস্টিগেশন ব্যুরোর (পিবিআই) কাছে হস্তান্তর করা হয়। দুই দফায় আসামিদের রিমান্ডে নেয় পিবিআই। ইতিমধ্যে আদালতে মামলা নিয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদনও দাখিল করা হয়েছে। আর এই অগ্রগতি প্রতিবেদনে গুদাম কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম এবং সাইদুল ইসলাম সাহেদ স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়ার ভুয়া কপি জমা দিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দিতে চান। আর এই ৭টি ডিটেনশন মেমো (ডিএম) জমা না দেওয়ার বিষয়টি পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
এ ছাড়া স্বর্ণ গায়েবের ঘটনা প্রকাশ্যে না আসার কারণে প্রায় ৮০ লাখ টাকার স্বর্ণ কিনে গুদামে জমা রাখারও প্রমাণ পায় পিবিআই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান বলেন, ‘৫৫ কেজি স্বর্ণ গায়েবের ঘটনা নিঃসন্দেহে অস্বাভাবিক এবং দুঃখজনক। আমরা শুরু থেকেই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। একাধিক তদন্ত সংস্থা কাজ করছে। তবে তদন্তপ্রক্রিয়া জটিল হওয়ায় এবং বিভিন্ন দিক যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে সময় লাগছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কোনোভাবেই ঘটনার দায় এড়াতে চাই না। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার জন্য আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি। যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তারা যত প্রভাবশালীই হোক না কেন, ছাড় পাবে না।’
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন