আর কিছুদিনের মধ্যেই ঘোষণা হতে যাচ্ছে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাজেট। প্রতিবছরের মতো সামাজিক সুরক্ষা খাতসহ নানান বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে তৈরি হয়েছে বাজেটের খসড়া প্রতিবেদন। কিন্তু প্রতিবছরই জাতীয় বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকে না দেশের প্রায় ১৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য। তাদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি, যোগাযোগ এমনকি অবকাঠামোগত উন্নয়নে নজর থাকে না কোনো সরকারেরই। যেখানে ঊর্ধ্বমূল্যের নিত্যপণ্য কিনতে সাধারণ মানুষের জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠছে, সেখানে এখনো প্রতিবন্ধীরা মাসে ভাতা পাচ্ছেন মাত্র সাড়ে ৮শ টাকা। যা ৩০ দিনের নাশতার খরচও না বলে মত তাদের। তাই আসন্ন জাতীয় বাজেটে পর্যাপ্ত পরিমাণ বরাদ্দ রাখার আহ্বান প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের। তবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রতিবন্ধীসহ সমাজের অবহেলিত সব জনগোষ্ঠীর সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর কাজ চলছে। যারা বিভিন্ন রকমের ভাতাভোগী বর্তমান সময়ের আলোকে তাদের ভাতা বাড়ানোরও কাজ চলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়ন করতে হলে অবশ্যই তাদের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। বাজেটে যে বরাদ্দ দেওয়া হয় তারও সঠিক বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিবছরের বাজেটে যে পরিমাণ বরাদ্দ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দেওয়া হয়, তা একেবারেই অপ্রতুল। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ শতাংশের কম, মাত্র শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশ। সমাজের এই অবহেলিত জনগোষ্ঠীর বিশেষ শিক্ষা উপকরণ প্রয়োজন হলেও যথেষ্ট বরাদ্দের অভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তা সরবরাহ করতে পারে না। ফলে চাইলেও তাদের যথাযথ শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায় না। তবে সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষার উপকরণ সরবরাহ করা হলে তাদেরও যথাযথ শিক্ষায় শিক্ষিত করা যেতে পারে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বাজেটে কেমন বরাদ্দ থাকা উচিত প্রসঙ্গে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, প্রতিবন্ধী শিশুদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে তাদের স্বাস্থ্যগত ও চিকিৎসার বিষয়টি নিশ্চিত করা। আমাদের এখানে যেসব বাচ্চা লেখাপড়া করে তাদের বেশির ভাগই নিম্নবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষ। ফলে তাদের পরিবারে যখন এমন একটি শিশু থাকে, তখন স্বাভাবিকভাবেই অন্য বাচ্চাদের তুলনায় তার খরচের খাত বেশি হয়।
তিনি বলেন, দেশের প্রতিটি জেলায় স্বাস্থ্যসেবার জন্য একটি করে হাসপাতাল আছে। কিন্তু প্রতিবন্ধী বাচ্চারা চিকিৎসা নিতে পারে এমন বিশেষায়িত হাসপাতাল নেই। সরকারের সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা ও কাউন্সেলিং সেবার মান বাড়াতে হবে। এ ছাড়া এখন উন্নত প্রযুক্তি তথা কৃত্রিম অঙ্গ, হিয়ারিং ও হুইল চেয়ারের সহায়তার জন্য সরকারের কোনো বরাদ্দ নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমাজের উচ্চবিত্তরা মূলত প্রতিবন্ধী শিশুদের সহায়তা করে থাকে। এ ছাড়া বিদেশি দাতাসংস্থার কাছ থেকে কিছু সহায়তা পাওয়া যায়। এভাবেই মূলত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ হয়। কিন্তু বাজেটে আসলে কী পরিমাণ বরাদ্দ থাকে সেটি কখনো স্পষ্ট করা হয় না সরকারের পক্ষ থেকে।
শুধু শিক্ষা বা স্বাস্থ্য নয়, বাজেটে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য গণপরিবহন, অবকাঠামোগত কোনো খাতেই নেই পর্যাপ্ত বরাদ্দ। বেশিরভাগ জায়গায়ই নেই তাদের চলাচলের জন্য উপযুক্ত র্যাম। তাই গণপরিবহনকে প্রতিবন্ধীবান্ধব করা উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের নিয়ে চলাচল করা সবচেয়ে কঠিন। তারা স্বাভাবিকভাবে কোনো কিছুই করতে পারে না। এখানে শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশু আছে, অস্বাভাবিক হাত, কথা না বলার মতো বাচ্চা আছে। তাদের যদি যথাযথ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া সম্ভব হতো, তাহলে অন্যদের মতোও তারা জীবনযাপন করতে পারত বলে মত তাদের।
এ বিষয়ে উইমেন উইথ ডিজঅ্যাবলিটি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (ডাব্লিউডিডিএফ)-এর নির্বাহী পরিচালক আশরাফুন নাহার মিষ্টি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আমরা বাজেটে যেটি দেখতে চাই সেটি হলো বাজেটটা আসলে সবার জন্য হওয়া দরকার, সবার জন্য উন্নয়ন খাতগুলো থাকে, শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকরি, যোগাযোগ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, শিশুদের জন্য উন্নয়ন, সব জায়গায় যেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য একটা পার্সেন্টেজ থাকে সেটার দাবি আমাদের। সে পার্সেন্টেজটা হতে পারে, আমরা যেহেতু জানি প্রায় ১৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে রয়েছে, সেই ১৫ শতাংশ ধরেই, যেমন শিক্ষা খাতে যে বাজেট আছে তার ন্যূনতম ১৫ শতাংশ যদি তা নয় অন্তত ১০ শতাংশ বাজেট প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য দেওয়ার জন্য। অর্থাৎ শিশুরা এখান থেকে শিক্ষা উপবৃত্তি পাবে, প্রশিক্ষণ পাবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রবেশগম্য হবে। আমরা প্রবেশগম্যতা বলতে শুধু বুঝি একটা র্যাম থাকলেই হয়। আসলে একটা র্যাম থাকলেই হয় না।
প্রবেশগম্য বলতে আমরা বুঝি, যে প্রতিষ্ঠানে ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখা করবে সেই প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধীরা আছেন তারাও যাবেন। সেখানে তাদের ওয়াশরুম সুবিধা থাকতে হবে। অর্থাৎ তারা যে টয়লেট ব্যবহার করবেন তা যেন প্রতিবন্ধীবান্ধব হয়। সেখানে হুইলছড়ি বা সাদাছড়ি বা ক্লাচ নিয়ে ঢুকতে পারবে। শিক্ষাক্ষেত্রে যেখানে ক্লাসরুম সেখানে প্রবেশ করতে পারবে। এ রকম বেশ কিছু বিষয়ে উন্নয়ন ঘটাবে। একই সঙ্গে যেসব অবকাঠামোগত উন্নয়ন হবে সবগুলোই প্রতিবন্ধীবান্ধব হবে। শুধু র্যাম না সেখানে সব ধরনের সুবিধাই থাকবে। সুতরাং আমরা যেটি চাই সেটি হচ্ছে উন্নয়ন খাতে ১৫ শতাংশ বাজেট যেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বরাদ্দ থাকে। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি সেখানে ০.২ শতাংশ অথবা ০.১ শতাংশ বরাদ্দ প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ থাকে। সেটাই বলা হয় প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। কিন্তু সেটির পরিমাণ আসলে বাড়াতে হবে। বিগত বছরগুলোতে আমরা দেখতে পাই ১ লাখ শিশু শিক্ষা উপবৃত্তি পাচ্ছে। কিন্তু প্রতিবছরই যেহেতু শিক্ষার্থীরা বাড়ে সেহেতু প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা বাড়ে। প্রতিবন্ধী শিশুদের অনেকেই তো জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী থাকে না। অনেকে বিভিন্ন রকমের দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। যেমন আমি হয়েছিলাম। এসএসসি পরীক্ষার পর একটি দুর্ঘটনায় আমি শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যাই। কিন্তু আমার জন্য কোনো বরাদ্দ ছিল না। সুতরাং আমি মনে করে উন্নয়নমূলক যতগুলো খাত রয়েছে সবগুলোতেই প্রতিবন্ধীদের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকা দরকার। আমরা যদি সামাজিক নিরাপত্তা সূচকটি বিশ্লেষণ করি সেখানে উল্লেখ ছিল ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আমাদের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতা হবে ৩ হাজার টাকা। সেখানে এখনো আমরা সাড়ে ৮শ টাকা ভাতা পাচ্ছি। এ বাজেট সামাজিক নিরাপত্তার জন্য একেবারেই অপ্রতুল। তাহলে তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা বরাদ্দ দরকার। প্রয়োজনে আলাদা ব্যবস্থা নিতে হবে।
তবে প্রতিবন্ধী ভাতাসহ বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতার পরিমাণ বাড়ানোসহ সমাজের পিছিয়ে পড়া, অনগ্রসর অংশ, বেকার, ভূমিহীন, অনাথ, দুস্থ, ভবঘুরে, নিরাশ্রয়, সামাজিক, বুদ্ধিমত্তা এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে বলে দাবি করেছেন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. মহিউদ্দিন। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নে শুরুর দিকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আপনারা জানেন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের মাঠপর্যায়ে কোনো জনপ্রতিনিধি নেই। ফলে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় প্রকৃত উপকারভোগী নির্বাচন করতে গিয়ে অনেক বেগ পোহাতে হয়েছে। সেই অবস্থা থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি। আমাদেও ডেটাবেস প্রস্তুত। পূর্বের বিভিন্ন সরকারের নেওয়া জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমগুলোর পরিধিকে আমরা আরও বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করছি। প্রতিবন্ধী ভাতা, বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তিসহ সব ভাতার পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে। যেসব ভাতার পরিমাণ বাড়ানো যাচ্ছে না সে ক্ষেত্রে উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। মূলকথা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সেবায় কোনো কাজই থেমে নেই।
তিনি বলেন, ভাতাভোগীর তালিকা নির্ধারণে যে নীতিমালা তাতে বলা হয়েছে, প্রতিটি ভাতা কর্মসূচি বাস্তবায়নে ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা, জেলা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে কমিটি রয়েছে। কমিটিতে জনপ্রতিনিধিকে সভাপতি হিসেবে রাখা হয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে এ কমিটি না থাকলে বিকল্প কী হতে পারে, তা নীতিমালায় বলা আছে। সেখানে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাকে সভাপতি করা আছে। কিন্তু এ তথ্য অনেকে জানেন না। ফলে উপকারভোগীর তালিকা করতে দেরি হচ্ছিল।
গত বছর বয়স্কভাতা ৬০ লাখ মানুষ পেয়েছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ বছর সেই সংখ্যা বেড়ে ৬১ লাখের মতো হয়েছে। তারা সবাই মাথাপিছু মাসিক ৬শ টাকা করে মাসিক ভাতা পাবেন। মাসিক ৫৫০ টাকা করে বিধবা ভাতা পেতেন ২৮ লাখ নারী। তাদের ভাতার পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে। মাথাপিছু ৮৫০ টাকা করে প্রতিবন্ধী ভাতা পেতেন ৩২ লাখ। তাদেরও ভাতা বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। যা আসন্ন বাজেটে বাস্তবায়ন প্রস্তাবনা করা হবে।
আপনার মতামত লিখুন :