বৃহস্পতিবার, ০৫ জুন, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: জুন ৪, ২০২৫, ০৪:০২ এএম

প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে এসএমই খাতের উদ্যোক্তারা

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: জুন ৪, ২০২৫, ০৪:০২ এএম

ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) শব্দটি ছোট হলেও গভীরতা অনেক বেশি। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সংক্ষিপ্ত রূপ হলো এআই। সফটওয়্যারের মাধ্যমে এটি ব্যবহারে মানুষের মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করে উন্নত থেকে উন্নত পরিসরে নেওয়া যায়। ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি (সিএমএসএমই) শিল্প খাতে এআই ব্যবহার ছোট পরিসরে কিছুটা শুরু হলেও বড় অংশ এর বাইরে রয়েছে। 

এসএমই ফাউন্ডেশনের এক তথ্য বলছে, দেশের ৮২ শতাংশ উদ্যোক্তারই নেই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সম্পর্কে সচেতনতা। মোটা দাগে পাঁচটি প্রতিবন্ধকতায় এসএমই খাতে প্রযুক্তি এবং এআই ব্যবহারে উদ্যোক্তারা পিছিয়ে রয়েছেন। শুধু প্রযুক্তি ব্যবহারের ঘাটতিতে এসএমই খাতে প্রতি বছর ৩-৫ শতাংশ উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে। আর এ নিয়ে গবেষণার হারও খুবই নিম্নমানের। বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের যেখানে ৫ শতাংশ বাজেট থাকে গবেষণায়, সেখানে এসএমইএ খাতে বরাদ্দ থাকে মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ।

এর বাইরেও খাতটিতে অজ্ঞতা (প্রযুক্তিগত) ও প্রশিক্ষণের অভাব, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে উচ্চ ব্যয় (বিনিয়োগ), ভাষাগত সীমাবদ্ধতা (সফটওয়্যারের ভাষা ইংরেজি), ডিজিটাল অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা (মফস্বলে) এবং নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে প্রযুক্তি ব্যবহারে অনীহা চরম আকারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য গবেষণা দরকার হলেও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এই খাতে খুব বেশি টাকা খরচ করছে না। বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫ শতাংশ এবং এসএমই খাতে ১-২ শতাংশ গবেষণা খাতে ব্যয় করছে। এটি শঙ্কা তৈরি করছে এসএমই খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে। 

এসএমই ফাউন্ডেশনের জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৮২ শতাংশ উদ্যোক্তা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতন নন, আর ৬৬ শতাংশ জানেন না কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিকস বা আইওটি ব্যবসায় কাজে লাগতে পারে। তবে প্রযুক্তির ছোঁয়া ও এআইয়ের ব্যবহার হলে বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এসএমই খাতের অবদান যেখানে ৩০ শতাংশ আছে, সেটি আরও বেড়ে যেত। বিশ্বব্যাংকের ভিন্ন একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, এসএমই খাতে প্রযুক্তির ঘাটতিতে প্রতি বছর ৩-৫ শতাংশ উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে।

এদিকে এসএমই খাতে প্রযুক্তি ব্যবহারে নীতিগত সহায়তাও খুব কম। জাতীয় ‘এসএমই নীতিতে’ প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়নের কথা থাকলেও বাস্তবে তা ভিন্ন। উদ্যোক্তারা জানেন না কী প্রযুক্তি প্রয়োজন, কোথায় পাবেন, কীভাবে শুরু করবেন। এ ছাড়া প্রযুক্তির ব্যবহার আরও কঠিন হয়ে গেছে, কারণ আইসিটির ২৭ খাত করমুক্ত থাকলেও চলতি অর্থবছরে তা ১৯-এ নেমেছে। কর-ভ্যাটের অভাব এবং অব্যাহত সংকোচন প্রযুক্তি খাতে অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিয়েছে।

কাগজের তৈরি বিভিন্ন পণ্য নিয়ে কাজ করছে জেডএফ হ্যান্ডিক্রাফট। প্রতিষ্ঠানটি তাদের বেশ কিছু পণ্য বিদেশেও রপ্তানি করছে। জেডএফ হ্যান্ডিক্রাফটের রাজধানীর জুরাইনে তাদের কারখানায় গিয়ে দেখা গেল, নিত্যনতুন পণ্য তৈরিতে কাজ করছে প্রায় অর্ধশত কর্মী। 

সেখানেই কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (অপারেশন) এস এম মহিউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা নিজেরাই পণ্যের ডিজাইন করে থাকি। প্রযুক্তির ব্যবহার করি। ইন্টারনেট থেকে নিত্যনতুন ডিজাইন নিজেদের মতো করে তৈরি করে থাকি।’ 

রাঙ্গামাটির উদ্যোক্তা সুপর্ণা তঞ্চঙ্গ্যা। নিজেকে তৈরি করেছেন উদ্যোক্তা হিসেবে। গড়ে তুলেছেন কাঞ্চি ফ্যাশন হাউস। তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তির মাধ্যমে এখন সব কাজ করতে হচ্ছে। বাজারজাত করার জন্য আমার পণ্যগুলো সুন্দর করে ছবি তুলে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করি। যারা আগ্রহী হন, তাদের ঠিকানা নিয়ে পণ্য ডেলিভারি দিই।’

তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে প্রযুক্তি দিয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তুললে কাজগুলো আরও সহজভাবে করা যেত। এসএমই খাত যাতে আরও প্রযুক্তিনির্ভর হয়, সে বিষয়ে সরকারের সহযোগিতা চান এই উদ্যোক্তা।

দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ব্যাবসায়িক কার্যক্রমকে ডিজিটালাইজড করতে নতুন একটি সফটওয়্যার প্ল্যাটফর্ম নিয়ে এসেছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সেলোস্কোপ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক সৈয়দ আহমদ রসুল জানান, এই সফটওয়্যার মূলত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য, যারা সীমিত বাজেট ও প্রযুক্তিজ্ঞান নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করেন। 

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের বেশির ভাগ উদ্যোক্তা হিমশিম খান হিসাব-নিকাশ, স্টক ম্যানেজমেন্ট, কাস্টমার রেকর্ড ও বিক্রয় বিশ্লেষণের মতো কাজগুলোতে সঠিকভাবে সমন্বয় করতে। আমরা তাদের জন্য একটি সফটওয়্যার তৈরি করেছি, যা মোবাইল ফোন থেকেই ব্যবহার করা যায় এবং এতে উদ্যোক্তারা সহজেই তাদের ব্যবসা পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।’ সেলোস্কোপের দাবি, এই সফটওয়্যার শহর থেকে শুরু করে মফস্বলের ব্যবসায়ী, হস্তশিল্প উদ্যোক্তা, ক্ষুদ্র কৃষিভিত্তিক ব্যবসায়ী, এমনকি ফ্রিল্যান্সারদেরও উপকারে আসবে।

সব শ্রেণির উদ্যোক্তাদের জন্য বর্তমানে বেশ জনপ্রিয় একটি অ্যাপ হচ্ছে টালী খাতা। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটের তথ্যে দেখা গেছে, বাংলাদেশের বৃহত্তম এসএমই প্ল্যাটফর্ম মাসে ১০ লাখের বেশি ব্যবহারকারী টালী খাতা ব্যবহার করে। এ ছাড়া মাইক্রো-মার্চেন্ট ব্যবসায়ীরা সঠিকভাবে হিসাব রাখতে, ডিজিটাল পেমেন্টের মাধ্যমে বিক্রি বাড়াতে এবং লোনের মাধ্যমে ব্যবসা বাড়াতে টালী খাতা ব্যবহার করছে। প্রতিষ্ঠানটির কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধি আসিক রহমান বলেন, ‘গুগল অ্যাপস থেকে টালী খাতা ডাউনলোড করে যে কেউ এটি ব্যবহার করতে পারেন। তবে ব্যবহারে সহজলভ্যতার কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাই বেশি এটি ব্যবহার করে থাকেন। আমাদের এখান থেকে অ্যাপসটি ব্যবহার করতে কারও কোনো সমস্যা হলে সেটি সমাধান করে দেওয়া হয়।’

সরকারের গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক এম কে মুজেরী বলেন, এশিয়ান মিরাকল দেশ হিসেবে খ্যাত চীন, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, জাপান এসব দেশের অর্থনীতির ডায়নামিক খাত হচ্ছে এসএমই। তারা প্রযুক্তি ব্যবহার করেই এগিয়ে যাচ্ছে। এখন রোবট, এআই এসব উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার না করলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। ফলে এসএমই খাতে প্রযুক্তিকে অবহেলা করা যাবে না।

এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘এখন সবকিছুই প্রযুক্তিনির্ভর। গ্রামীণ একটি বড় অংশ এখনো এই প্রযুক্তিগত সেবা থেকে দূরে আছে। যেহেতু সবার হাতেই এখন স্মার্টফোন আছে, সেহেতু আমরা চাই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা যারা আছে, তারা এই স্মার্টফোনের মাধ্যমে প্রযুক্তির প্রথম ধাপটিতে পৌঁছাক।’

তিনি বলেন, ‘এসএমই উদ্যোক্তাদের সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে উৎপাদনশীলতায়। এর জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বাড়াতে হবে। তা না হলে আমরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ব। এসএমই  ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে উদ্যোক্তাদের সহায়তা করা হচ্ছে।’

যে পাঁচ প্রতিবন্ধকতায় পিছিয়ে আছেন উদ্যোক্তারা

মোটা দাগে পাঁচটি প্রতিবন্ধকতায় এসএমই খাতে প্রযুক্তি এবং এআই ব্যবহারে উদ্যোক্তারা পিছিয়ে রয়েছেন। সেগুলো হচ্ছে অজ্ঞতা (প্রযুক্তিগত) ও প্রশিক্ষণের অভাব, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে উচ্চ ব্যয় (বিনিয়োগ), ভাষাগত সীমাবদ্ধতা (সফটওয়্যারের ভাষা ইংরেজি), ডিজিটাল অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা (মফস্বলে) এবং নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে প্রযুক্তি ব্যবহারে অনীহা। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য গবেষণা দরকার হলেও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এই খাতে খুব বেশি টাকা খরচ করছে না। বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫ শতাংশ এবং এসএমই খাতে ১-২ শতাংশ গবেষণা খাতে ব্যয় করছে। এটি শঙ্কা তৈরি করছে এসএমই খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে।

প্রশিক্ষণের পর নেই কার্যকর প্ল্যাটফর্ম, পরামর্শ বা টেক সাপোর্ট

থাইল্যান্ডে ৪০ শতাংশ এসএমই এরই মধ্যে আইওটি ও স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করেছে, মালয়েশিয়ায় ডিজিটাল স্কিলস প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। সরকারও দেয় ভর্তুকি। আর বাংলাদেশে প্রযুক্তি ব্যবহার ৫ শতাংশের নিচে, তা-ও শুধু বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমিত। গ্রাম ও শহরতলির বেশির ভাগ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এখনো রয়ে গেছেন অ্যানালগ পদ্ধতির মধ্যে। ভারতের ‘ডিজিটাল এমএসএমই স্কিম’-এ বছরে ৫ লাখ উদ্যোক্তা প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন আর বাংলাদেশে এই সংখ্যা ৫০ হাজার, তা-ও কাগজে-কলমেই। মাঠপর্যায়ে এর প্রভাব নেই। কারণ প্রশিক্ষণের পর নেই কার্যকর প্ল্যাটফর্ম, পরামর্শ বা টেক সাপোর্ট। ২০২৪-২৫ বাজেটে এসএমই খাতে প্রযুক্তি ব্যবহারে নেই আলাদা বরাদ্দ বা প্রশিক্ষণ কোটা। নারী উদ্যোক্তারা আরও পিছিয়ে। এটি যেন মাঝপথে প্রশিক্ষণ দিয়ে ফেলে রাখার মতো অবস্থা।

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবিরের মতে, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ক্লাউডভিত্তিক অ্যাকাউন্টিং ও ইনভেনটরি সফটওয়্যার অত্যাবশ্যক। সরকার স্বল্পমূল্যে এসব সরবরাহ করলে এসএমইরা সহজে প্রযুক্তিনির্ভর হতে পারে। অনলাইনে বিক্রির জন্য প্রয়োজন ডিজিটাল কমার্স ফ্রেমওয়ার্ক, যা অনেকের নেই। এ জন্য এসএমই ফাউন্ডেশন একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে পণ্যের প্রদর্শন ও বিপণনে ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি তিনি মনে করেন, নীতিগত সীমাবদ্ধতাগুলো এখনই পুনর্বিবেচনা করা জরুরি। বিশ্বব্যাংকের ‘এন্টারপ্রাইজ সার্ভে’ অনুযায়ী, দেশে মাত্র ১২ শতাংশ এসএমই ডিজিটাল টুল ব্যবহার করছে। তা-ও শুধু বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমিত। গ্রাম ও শহরতলির বেশির ভাগ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এখনো রয়ে গেছেন পুরোনো পদ্ধতির মধ্যে।

Link copied!