অভিবাসনবিরোধী অভিযানের বিরুদ্ধে এবার যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প লস অ্যাঞ্জেলেসে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্টের (আইস) কড়া অবস্থানকে সমর্থন জানিয়ে বক্তব্য দেওয়ার পর এই বিক্ষোভগুলো আরও জোরদার হয়েছে। অভিবাসীবিরোধী অভিযানের প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লস অ্যাঞ্জেলেসে যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে, তার ঢেউ এবার টেক্সাসেও লেগেছে। টেক্সাসের অস্টিনে শতাধিক মানুষের একটি বড় দল মিছিল করে জে জে পিকল ফেডারেল ভবনের দিকে যায়। ভবনটি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই) কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। টেক্সাসে এদিন বিক্ষোভকারীদের হাতে ব্যানার ও পতাকা ছিল। পুলিশের মুখোমুখি হলে তারা ‘আইসিই নিপাত যাক’ বলে ¯স্লোগান দিতে থাকেন। মিছিল নিয়ে দলটি ফেডারেল ভবনে পৌঁছানোর পর সেখানে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। অস্টিন পুলিশ সমাবেশকে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে বিক্ষোভকারীদের সরে যেতে বলে।
বলা হয়, যদি তারা সরে না যায়, তাহলে তাদের গ্রেপ্তার করা হতে পারে অথবা রাসায়নিক পদার্থের মুখোমুখি হতে হবে। পুলিশের ঘোষণার পরও বিক্ষোভকারীরা না সরলে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে।
ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন শহরেও প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলীয় শহর সান ফ্রান্সিসকোতে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। সেখানে প্রায় ১৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার বাইরেও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। নিউইয়র্ক সিটিতে ফেডারেল ভবনের সামনে গাড়ি আটকে দিয়ে প্রতিবাদ করায় অনেককেই গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। খবর সিএনএনের।
গত ৬ জুন শুক্রবার লস অ্যাঞ্জেলেসের শহরতলী এলাকা প্যারামাউন্টে নথিবিহীন অভিবাসীদের শনাক্ত ও আটক করতে অভিযানে নামেন পুলিশ ও আইসিই সদস্যরা। তবে অভিযানের শুরুতেই তারা ব্যাপক প্রতিরোধের সম্মুখীন হন। প্যারামাউন্টের বাসিন্দারা তীব্র বিক্ষোভের পাশাপাশি পুলিশ ও আইসিই সদস্যদের লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল, বোতল ও মলোটভ ককটেল বা পেট্রোল বোমা ছুড়তে থাকেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে গত চার দিন ধরে চলা বিক্ষোভ এবার ছড়িয়ে পড়েছে টেক্সাস অঙ্গরাজ্যেও। টেক্সাসের অস্টিনে অবস্থিত জে জে পিকল ফেডারেল ভবনের দিকে শতাধিক মানুষের একটি মিছিল যেতে দেখা গেছে। গতকাল মঙ্গলবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। বিবিসি জানিয়েছে, জে জে পিকল ফেডারেল ভবনটি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই) কেন্দ্র হিসেবে হিসেবে পরিচিত। কেন্দ্রটি ঘেরাওয়ের উদ্দেশ্যেই বিক্ষোভকারী সেখানে জড়ো হয়েছেন।
এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্য প্রশাসন। লস অ্যাঞ্জেলেসে ‘বেআইনিভাবে’ সেনা মোতায়েনের অভিযোগে গত সোমবার এ মামলা দায়ের করা হয়। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান গতকাল মঙ্গলবার (১০ জুন) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
আদালতে দায়ের করা অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, লস অ্যাঞ্জেলেসে জাতীয় নিরপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা ট্রাম্পের ফেডারেল কর্তৃত্ববহির্ভূত এবং দশম সংশোধনীর অভ‚তপূর্ব লঙ্ঘন। ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্য প্রশাসনের দায়ের করা অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, তার প্রতিরক্ষাসচিব ও প্রতিরক্ষা বিভাগের অবৈধ পদক্ষেপ থেকে রাজ্যকে রক্ষা করার জন্য ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর এই মামলাটি দায়ের করেছেন।
অনিবন্ধিত অভিবাসীদের বিরুদ্ধে তল্লাশি অভিযানের প্রতিবাদে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লস অ্যাঞ্জেলস শহরে টানা চতুর্থ দিনের মতো বিক্ষোভ-সংঘর্ষ হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে ২ হাজার ন্যাশনাল গার্ডের পাশাপাশি সাময়িকভাবে ৭০০ মেরিন সেনা মোতায়েন করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, সেইসঙ্গে লস অ্যাঞ্জেলসে আরও ২ হাজার ন্যাশনাল গার্ড সদস্য মোতায়েন করতে যাচ্ছে মার্কিন সামরিক বাহিনী। ন্যাশনাল গার্ডের এই সদস্যদের সেখানে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত ফেডারেল বাহিনীকে সহায়তা করবে ৭০০ মেরিন সেনা।
যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণত কোনো অঙ্গরাজ্যের গভর্নরের অনুরোধ সাপেক্ষে সেখানে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েনের নির্দেশ দেন প্রেসিডেন্ট। তবে এবার ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গাভিন নিউসমের অনুরোধ ছাড়াই বাহিনীটি মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ট্রাম্প। তার এমন পদক্ষেপের বিরোধিতাও করেছেন নিউসম। তবে তা কানে তোলেননি ট্রাম্প।
নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প লেখেন, ‘ক্যালিফোর্নিয়ায় সহিংস, উসকানিমূলক দাঙ্গা মোকাবিলার জন্য ন্যাশনাল গার্ড পাঠানোর সিদ্ধান্তটি চমৎকার ছিল। আমরা যদি এমনটা না করতাম, তা হলে লস অ্যাঞ্জেলেস পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যেত।’
গভর্নর গাভিন নিউসম ও লস অ্যাঞ্জেলেসের মেয়র কারেন বাসের সমালোচনা করে ট্রাম্প লেখেন, ‘চরম অযোগ্য গভর্নর গাভিন নিউসম ও মেয়র কারেন বাসের বলা উচিত ছিল, ‘ধন্যবাদ, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। আপনি খুবই অসাধারণ। আপনি ছাড়া আমরা কিছু করতে পারতাম না। তবে তারা আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার মানুষের সঙ্গে মিথ্যা বলাকে বেছে নিয়েছেন।’
গত ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণের পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে অবৈধ অভিবাসন উচ্ছেদ এবং নথিবিহীন অভিবাসীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো সংক্রান্ত একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছিলেন ট্রাম্প। তারপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে অভিযান শুরু করে পুলিশ এবং মার্কিন কাস্টমস বিভাগের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা আইসিই। পুলিশ ও আইসিই’র যৌথ অভিযানে গত প্রায় ৬ মাসে শত শত নথিবিহীন অভিবাসীকে আটক করে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
এ ছাড়া নথিবিহীন অভিবাসীদের সংখ্যা বেশি এমন অঙ্গরাজ্যগুলোতে পৃথক বন্দিশালা বা ডিটেনশন সেন্টার করা হয়েছে। সেসব বন্দিশালায় আটক আছেন আরও হাজার হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী।
প্রশান্ত মহাসাগরের উপক‚লে অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার নথিবিহীন অভিবাসী আছেন। এদের অধিকাংশই মেক্সিকো এবং দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা। সাধারণত শহরতলী এলাকাগুলোতে তারা থাকেন। ডালাসে প্রায় ৪০০ জনের একটি দল মার্গারেট হান্ট হিল ব্রিজে জড়ো হয়, যা মূলত শান্তিপূর্ণ জমায়েত ছিল বলে ডালাস মর্নিং নিউজ জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে অভিবাসনবিরোধী বিক্ষোভের সংবাদ প্রচারকালে অস্ট্রেলিয়ার ‘নাইন নিউজ’-এর নারী সাংবাদিক লরেন তোমাসি রাবার বুলেটে আহত হয়েছেন। সরাসরি সম্প্রচারের সময় ক্যামেরায় ধরা পড়েছে ঘটনাটি। রোববার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের প্রতিবাদে উত্তপ্ত ছিল গোটা লস অ্যাঞ্জেলেস। এক পর্যায়ে সেখানকার পুলিশ ডিপার্টমেন্ট এবং ন্যাশনাল গার্ড সৈন্যরা বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। আর সেই সংবাদই প্রচার করছিলেন অস্ট্রেলিয়ার গণমাধ্যম ‘নাইন নিউজ’-এর নারী সাংবাদিক লরেন তোমাসি।
এদিকে সান ফ্রান্সিসকো পুলিশ গত রোববারের বিক্ষোভ কর্মসূচির সম্পর্কে একটি হালনাগাদ তথ্য দিয়েছে। পুলিশের ভারপ্রাপ্ত প্রধান পল ইয়েপ জানিয়েছেন, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ শেষ পর্যন্ত সহিংসতা ও সম্পত্তি ধ্বংসে পরিণত হয়।
পল ইয়েপ আরও জানান, বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। তবে তিনি এখন সুস্থ হয়েছেন। বিক্ষোভ ছেড়ে যেতে অস্বীকৃতি জানানো ৬০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রোববার রাতভর বিভিন্ন স্থান থেকে ১৪৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ছয়জন অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিল। ১৪৭ জনকে পরে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের অর্ধেক সান ফ্রান্সিসকোর বাসিন্দা, আর বাকি অর্ধেক শহরের বাইরের বাসিন্দা ছিলেন লস অ্যাঞ্জেলেস ও এর আশপাশের এলাকায় এই বিক্ষোভ শুরু হয় গত শুক্রবার। গত সোমবার তা আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে। এদিন রাস্তায় নেমে আসেন হাজার হাজার বিক্ষোভকারী। সড়ক অবরোধসহ গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে ন্যাশনাল গার্ডের দুই হাজার সদস্যকে মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯২ সালের পর থেকে এই প্রথম ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করলেন দেশটির কোনো প্রেসিডেন্ট। সে বছর লস অ্যাঞ্জেলেসে শুরু হওয়া দাঙ্গা মোকাবিলায় ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করা হয়েছিল। রডনি কিং নামের একজন কৃষ্ণাঙ্গ গাড়িচালককে মারধরের অভিযোগ থেকে চার শেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তাকে খালাস দেওয়ার পর ওই দাঙ্গা শুরু হয়েছিল।
হোম ডিপোর এই শাখা ঘিরে একটি গুজব থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসে ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন দমনবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে বিবিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বিক্ষোভের আগে গুজব ছড়িয়েছিল, এখানকার দিনমজুরদের ধরে নেওয়া হয়েছে এবং গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অভিবাসী দিনমজুরদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পর হিস্পানিক অধ্যুষিত প্যারামাউন্ট শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভ একসময় সহিংস রূপ নেয়, ছোড়া হয় ইটপাটকেল ও মলোটভ ককটেল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কর্তৃপক্ষ পিপার স্প্রে, রাবার বুলেট ও ধোঁয়ার বোমা ব্যবহার করে।
এলাকাবাসীর অনেকে বিবিসিকে বলেছেন, তারা সেখানে অভিবাসন কর্তৃপক্ষের গাড়ি দেখতে পেয়েছেন। অভিবাসন কর্তৃপক্ষের গাড়ি দেখতে পাওয়ার খবরে ওই এলাকায় সঙ্গে সঙ্গে ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এরপর খবর আসে, হোম ডিপোতে অভিযান চালিয়ে দিনমজুরদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুরো যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহু অনিবন্ধিত অভিবাসী কাজের খোঁজে হোম ডিপো চত্বরে জড়ো হন।