১৯৯৮ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পর আর কোনো আইসিসির শিরোপা জিততে পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। অস্ট্রেলিয়াকে ৫ উইকেটে হারিয়ে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতল প্রোটিয়ারা। দলের জয়ে সব সংস্করণ মিলিয়ে ৪৩ ইনিংস পর পাওয়া এইডেন মার্করামের লড়াকু সেঞ্চুরি রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
ফাইনালের প্রথম দিনে টস জিতে বোলিং নিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ম্যাচ শেষে অন্তত এটা স্পষ্টভাবেই বলা যায়, ওই টস জয়ই দক্ষিণ আফ্রিকার অর্ধেক কাজটা করে দিয়েছিল। কারণ দ্বিতীয় দিনের পর ব্যাটিং সহজ হয়ে যাওয়ার তার পুরো সুবিধাটাই পেয়েছেন এইডেন মার্করাম- টেম্বা বাভুমারা।
ম্যাচের শেষদিকে পিচ ব্যাটিং সহায়ক হয়ে যাওয়া মিচাল স্টার্ক, প্যাট কামিন্স এবং জশ হ্যাজেলউডদের মতো বোলাররা কোনো সুইং পাচ্ছিলেন না। অভিজ্ঞ নাথান লায়ন বল স্পিন করাতে পারলেও ভাঙতে পারেননি মার্করামদের প্রতিরোধ। তাই সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও ২৮১ রান ডিফেন্ড করতে পারেনি অজিরা। ভাগ্যদেবতাও হয়তো এটাই চেয়েছিলেন। চতুর্থ ইনিংসে ২৮২ রান তাড়া করে ৫ উইকেটের জয় ছিনিয়ে নিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা।
আফ্রিকার বিশ্বজয়ের বড় নায়ক মার্করাম। এক বাক্যে বলতে গেলে, তার অপ্রতিরোধ্য ইনিংসটাই দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রথম বিশ্বজয়ের মুকুট এনে দিয়েছে। ২০৭ বলে ১৩৬ রানের ইনিংসে একজন টেস্ট ব্যাটারের মধ্যে যা থাকা দরকার সবকিছুই ছিল। দায়িত্বশীলতা, তীব্র মনোযোগ এবং ম্যাচ পরিস্থিতি অনুযায়ী শট খেলা, সবকিছুই দেখিয়েছেন মার্করাম। তাই একটা ইনিংসই প্রমাণ করে একবার ওই বিশ্বকাপ জয়ের জন্য কতটা মুখিয়ে ছিল প্রোটিয়ারা। জয় থেকে মাত্র ৬ রান দূরে থাকতে আউট হন প্রোটিয়া এই ব্যাটার। তবে ততক্ষণে জয়টা নিজেদের ঝুলিতে নিয়ে ফেলেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।
প্রোটিয়া অধিনায়ক বাভুমার কথাও না বললেই নয়। দলের সবচেয়ে প্রয়োজনের সময় ১৩৪ বলে ৬৬ রানের হার না মানা এক ইনিংস খেলেছেন তিনি। ৫ ঘণ্টারও অধিক সময় উইকেটে ছিলেন বাভুমা। তবে এর মধ্যে অর্ধেক সময়ই দৌড়েছেন খুড়িয়ে খুড়িয়ে। প্রথম ইনিংসেও তার ব্যাট থেকে আসে ৩৬ রান। দুই ইনিংসে ব্যাট হাতে দারুণ প্রতিরোধ দেখিইয়েছেন ডেভিড বেডিংহ্যাম। প্রথম ইনিংসে ৪৫ রান করার পর দ্বিতীয় ইনিংসে ২১ রানে অপরাজিত ছিলেন তিনি।
জয়ের আরেক বড় তারকা কাগিসো রাবাদা। দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে অভিজ্ঞ পেসার নিজেকে প্রমাণ করেছেন বড় মঞ্চে। দুই ইনিংস মিলিয়ে তিনি নিয়েছেন ৯ উইকেট। দুই ইনিংস মিলিয়ে ৪ উইকেট নিয়েছেন মার্কো ইয়ানসেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ৩ উইকেট গেছে লুঙ্গি এনগিডির ঝুলিতে।
টস জিতে বোলিং নিয়ে প্রথম ঘণ্টায়ই অস্ট্রেলিয়াকে ব্যাকফুটে ফেলে দিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ইয়ানসেন-রাবাদার তোপে প্রথম ইনিংসে মাত্র ৬৭ রান তুলতেই ৪ উইকেট হারায় অজিরা। মার্নাস লাবুশেন ও উসমান খাজার উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন রাবাদা। প্রথম স্লিপে আদায় করে নেন খাজার উইকেট। দ্বিতীয় উইকেটের জন্য রাবাদাকে খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। ওই ওভারেই তুলে নেন ক্যামেরন গ্রিনকে। গ্রিন ক্যাচ দেন স্লিপে দাঁড়ানো এইডেন মারক্রামকে।
লাবুশেনও ইনিংস বড় করতে পারেননি। উইকেটরক্ষক কাইলে ভেরাইনের গ্লাভসে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেন ইয়ানসেন। গত টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালের নায়ক ট্রাভিস হেড ফেরেন মাত্র ১১ রানে।
অভিজ্ঞ স্টিভ স্মিথ এবং বেউ ওয়েবস্টারের ব্যাটে শুরুর ৪ উইকেটের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠে অস্ট্রেলিয়া। পঞ্চম উইকেটে ৭৯ রান তোলে এই জুটি। ৬৬ রান করেন স্মিথ। ওয়েবস্টারও পান ফিফটির দেখা। মাত্র ২০ রানের ব্যবধানে শেষ পাঁচ উইকেট হারিয়ে প্রথম ইনিংসে ২১২ রানে অলআউট হয় অস্ট্রেলিয়া।
তবে এই ২১২ রান নিয়েও প্রথম ইনিংসে লিড পায় অস্ট্রেলিয়া। প্রথম দিনের শেষভাগে ব্যাট করতে নেমে অস্ট্রেলিয়ার মতো শুরুতেই চাপে পড়ে প্রোটিয়ারাও। ৩০ রানে প্রথম ৪ উইকেট হারায় দলটি। দলের খাতায় কোনো রান যোগ হওয়ার আগেই স্টার্কের বলে বোল্ড হয়ে সাজঘরে ফিরেছিলেন এইডেন মার্করাম। রায়ান রিকেলটন ১৬, উইন মুল্ডার ৬ আর ত্রিস্তান স্টাবস ২ রান করে আউট হন।
৪ উইকেট হারানোর পর ডেভিড বেন্ডিংহামকে নিয়ে হাল ধরেন বাভুমা। তবে তাদের ৬৪ রানের জুটি ভাঙেন কামিন্স। ৮৪ বলে ৩৬ রান করে বিদায় নেন প্রোটিয়া অধিনায়ক। এরপর কাইল ভেরেন্নে (১৩) ও ইয়ানসেনকেও (০) ক্রিজে স্থায়ী হতে দেননি কামিন্স। একপ্রান্ত আগলে রাখা বেডিংহ্যাম দলীয় ১৩৫ রানে বিদায় নেন। তার বিদায়ের পর দলের খাতায় আর মাত্র ৩ রান যোগ করতে পারেন বাকিরা। প্রথম ইনিংসে ১৩৮ রানে অলআউট হয় দক্ষিণ আফ্রিকা।
২১২ রান করেও প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়াকে লিড এনে দেয়ার নায়ক ছিলেন কামিন্স। অজি অধিনায়ক ওই ইনিংসে ২৮ রান দিয়ে নেন ৬ উইকেট। ২ উইকেট নেন মিচেল স্টার্ক।
৭৪ রানের লিড নিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে প্রোটিয়া পেসারদের সামনে একদমই সুবিধা করতে পারেনি। দলীয় ২৮ রানে উসমান খাজার উইকেট হারানোর পর ৪৫ রানের ব্যবধানে আরও ৬ উইকেট হারায় দলটি। লাবুশেনের ২২ এবং স্মিথের ১৩ রান ছাড়া প্রথম ছয় ব্যাটারের কেউই পৌঁছাতে পারেননি দুই অঙ্কে।
৭৩ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকা অস্ট্রেলিয়াকে অষ্টম উইকেটে মিচেল স্টার্কের সঙ্গে ৬১ রানের জুটি গড়ে টেনে তোলার চেষ্টা করেন অ্যালেক্স ক্যারি। তবে ব্যক্তিগত ৪৩ রানে ক্যারি যখন আউট হন তখন দলের সংগ্রহ ছিল ১৩৪। ১৪ রানের ব্যবধানে অজিরা হারায় নাথান লায়নের উইকেটও। তবে সেখান থেকে সংগ্রহটা ২০৭-এ নিয়ে যান মিচেল স্টার্ক। ৫৮ রানে অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়েন তিনি।
প্রথম ইনিংসে ১৩৮ রানে অলআউট হওয়া দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য দ্বিতীয় ইনিংসে ২৮২ রানটা একরকম পাহাড়সমানই লাগার কথা ছিল। তবে পিচ ব্যাটিং সহায়ক হয়ে যাওয়ায় সেটা তেমন কঠিন হয়ে দাঁড়ায় না প্রোটিয়াদের জন্য। দলীয় ৯ রানে রায়ান রিকেলটনের উইকেট হারানোর পর আক্রমণ শুরু করেন দুই ব্যাটার মার্করাম এবং উইয়ান মুল্ডার। দ্বিতীয় উইকেটে দুজনে ৬১ রানের জুটি গড়েন।
স্টার্কের শিকার হয়ে মুল্ডার ফেরার পর তৃতীয় উইকেটে বাভুমা-মার্করাম গড়েন ১৪৭ রানের জুটি। এই জুটিই গড়ে দেয় ম্যাচের ভাগ্য। শেষদিকে বাভুমা, মার্করাম এবং স্টাবসের উইকেট হারালেও সেটা প্রোটিয়াদের জয়ের পথে কোনো বাধা হতে পারেনি।