ঢাকা শনিবার, ১৪ জুন, ২০২৫

দেশের বৃহত্তর যুব ও তরুণদের সক্ষমতা বৃদ্ধি

বৃহৎ আশায় ক্ষুদ্র বরাদ্দ

হাসান আরিফ
প্রকাশিত: জুন ১২, ২০২৫, ০৩:৩৮ এএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের প্রথম বাজেটে উঠে এসেছে দেশের বৃহত্তর যুব জনগোষ্ঠীর দক্ষতা, উদ্ভাবন ও আত্মকর্মসংস্থান সক্ষমতা গড়ে তোলার দৃঢ় অঙ্গীকার। তার ঘোষিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে তারুণ্যকেন্দ্রিক প্রকল্প নেওয়ারও দাবি করা হয়েছে। এ জন্য তরুণ উদ্যোক্তা উন্নয়নে ১০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন সালেহউদ্দিন আহমেদ।

প্রস্তাবিত এই তহবিল থেকে যুবকরা সহজ শর্তে আর্থিক সহায়তা পাবে। পাশাপাশি সফল উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণের সীমা বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা এখন থেকে পাবেন ২ লাখ টাকা, যা আত্মকর্মসংস্থান গঠনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক উদ্যোগ হিসেবে দেখছে সরকার।

এদিকে বর্তমান সরকারের তারুণ্যকেন্দ্রিক প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত পরিকল্পনা দাবি করা হচ্ছে ‘তারুণ্যের উৎসব’। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে আয়োজিত এ কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০০ কোটি টাকা, যার উদ্দেশ্য তরুণদের রাষ্ট্রীয় অগ্রগতিতে কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

অর্থ উপদেষ্টার ঘোষণার সূত্রে জানা যায়, ‘এসো দেশ বদলাই, পৃথিবী বদলাই’ শীর্ষক প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ২০২৫ সালের এ উৎসব এরই মধ্যেই সারা দেশে উদ্দীপনা ও আশার আলো ছড়িয়েছে। এ পদক্ষেপের মাধ্যমে শুধু কর্মসংস্থান নয়, বরং এক নতুন প্রজন্মের মধ্যে নেতৃত্ব বিকাশের ক্ষেত্রও সৃষ্টি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সরকারের দাবি, জাতীয় পর্যায়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে। সংসদীয় কাঠামোর অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে এটি কার্যকর হবে ৩০ জুন। সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। সে সময়ে অর্থনৈতিক ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশকে ঘুরে দাঁড় করাতে আমাদের সবার অক্লান্ত পরিশ্রম প্রয়োজন হয়।’

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, তারুণ্যের উৎসব কর্মসূচি শুধু দেশের সীমানাতেই সীমাবদ্ধ রাখা হবে না। এটি ছড়িয়ে দেওয়া হবে বিশ্বময়। এ জন্য বাংলাদেশের বাইরে ৮টি মিশনেও করা হবে তারুণ্যের উৎসব। আর দেশের ভেতরে শুধু শহরকেন্দ্রিক উৎসব হবে না। এই উৎসব হবে দেশজুড়ে। যাতে দেশের সব তরুণ এই তারুণ্যের উৎসবে অংশ নিতে পারে।

বাজেট বক্তৃতায় তিনি উল্লেখ করেন, ‘অতীতের গ্লানিময় অর্থনৈতিক অবস্থানকে পেছনে ফেলে আমরা নতুন দিগন্তে যাত্রা শুরু করেছি। তরুণ জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা হচ্ছে, যা অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক শ্রমবাজারের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’

তরুণরা যে সুযোগ পেলে সফল হতে পারে এর বাস্তব উদাহরণ এস এ জাহিদ। তিনি একজন স্বনির্ভর উদ্যোক্তা, যিনি মাছ চাষ, মসলার ব্যবসা এবং প্রযুক্তিনির্ভর হোম ডেলিভারি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দেশের ৭০ জন বেকার যুবককে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছেন। তার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘ইনটেক অ্যাগ্রো’ বর্তমানে সারা দেশে স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যপণ্য সরবরাহ করে সুনাম কুড়িয়েছে। তিনি ২০২৪ সালের জাতীয় যুব দিবসে শ্রেষ্ঠ আত্মকর্মী হিসেবে পুরস্কৃত হন।

অর্থ উপদেষ্টার বক্তব্যে উঠে এসেছে এ ধরনের উদাহরণগুলো বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াস। তিনি বলেন, ‘শুধু রাজধানী নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলের যুবসমাজকেও সম্পৃক্ত করতে হবে উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে। এ জন্য প্রয়োজন যুগোপযোগী কারিগরি শিক্ষা, প্রয়োজনভিত্তিক প্রশিক্ষণ এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও একাডেমিয়ার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা।’

২০২৫-২৬ অর্থবছরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের জন্য মোট ২৪২৩ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে, যেখানে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ১ হাজার ৪৪০ কোটি ৩৭ লাখ এবং পরিচালন খাতে ৯৮২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এ বরাদ্দের আওতায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণ, ইনডোর গেমস অবকাঠামো উন্নয়ন, বিকেএসপি আধুনিকীকরণ, ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ, যুব কার্যক্রম গবেষণা এবং প্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন কর্মসূচি।

নতুন এই বাজেটে সবচেয়ে বড় অর্জন হতে পারে দেশের ৪৮টি জেলায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মপ্রত্যাশী যুবকদের জন্য ফ্রিল্যান্সিং ও প্রযুক্তি খাতে চাকরি সৃষ্টি। এতে প্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের ভিত্তি রচিত হবে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার তুলনায় এবারের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি কিছুটা কম। এতে কমেছে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। তবে বাজেটের গঠনমূলক কাঠামোতে বরাদ্দের গুরুত্ব বদলে গেছে। আগে যেখানে বড় অঙ্কের প্রকল্পের পেছনে টাকা ব্যয় হতো, এখন কর্মসংস্থান, প্রশিক্ষণ, উদ্যোক্তা সহায়তা, সামাজিক সুরক্ষা ইত্যাদিতে বেশি নজর দেওয়া হয়েছে।

অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম সংসদের বাইরে বাজেট উপস্থাপন হলো এমন এক বাস্তবতায়, যেখানে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। তবু আমরা গণতন্ত্রের চেতনায় অটুট থেকে অংশীজনের মতামত গ্রহণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি।’
এ ছাড়া বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তিনি বাজেট সম্পর্কিত সব প্রশ্নের জবাব দেন এবং পুরো জুন মাস তিনি বিভিন্ন খাতের বিশেষজ্ঞ, পেশাজীবী, শিক্ষার্থী ও নাগরিক সমাজের মতামত সংগ্রহ করবেন বলেও জানান।

এদিকে বাজেটে স্থান পেয়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদদের পরিবারের জন্য আত্মকর্মসংস্থানমূলক বিশেষ প্রকল্প। অর্থ উপদেষ্টার ভাষায়, ‘যারা দেশের পরিবর্তনের জন্য জীবন দিয়েছেন, তাদের উত্তরসূরিদের জন্য স্বনির্ভরতার পথ তৈরি করাও আমাদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব।’

সব মিলিয়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটকে বলা হচ্ছে এক ‘তারুণ্যবান্ধব’, ‘ভবিষ্যৎমুখী’ এবং ‘সমন্বিত মানবসম্পদ উন্নয়ন’ নির্ভর অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। এ পরিকল্পনার বাস্তবায়নই ঠিক করে দেবে আগামী প্রজন্মের পথচলা কতটা দৃঢ় ও সাফল্যমণ্ডিত হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুব ও ক্রীড়াবান্ধব এ বাজেট বাস্তবায়নে আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়, স্বচ্ছতা এবং তহবিলের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশে একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা হবে।