করোনা ভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের সাব-ভ্যারিয়েন্ট এক্সএফজি ও এক্সএফসির প্রভাবে হঠাৎ করে দেশে আবারও বাড়ছে করোনা রোগী। রাজধানীসহ অনেক জেলা শহরেও পাওয়া যাচ্ছে রোগী। বলা যায়, প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। মারাও যাচ্ছেন অনেকে।
কিন্তু আগের মতো এটি নিয়ন্ত্রণে নেই চোখে পড়ার মতো কোনো উদ্যোগ। খোদ রাজধানীতেও কেউ মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি। জেলা শহরে তো এর বালাই-ই নেই। এমন পরিস্থিতিতে আবারও করোনা ভাইরাস মহামাফর আকার ধারণ করার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্যমতে, চলতি বছরের শুরু থেকে গত শুক্রবার পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ২৮৩ জন। বেশির ভাগ রোগীই সাম্প্রতিক কয়েক দিনে বেড়েছে। এ সময় মৃত্যু হয়েছে পাঁচজনের। করোনায় আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে ময়মনসিংহেও। সম্প্রতি জেলাটিতে ১৪ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে।
তবে জেলা শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া গেছে চট্টগ্রামে। বিভাগীয় এই শহরে সম্প্রতি রোগী পাওয়া গেছে ৬৮ জন। মৃত্যুও হয়েছে একজনের। করোনা রোগী পাওয়া গেছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারেও।
এ জেলায় আক্রান্ত পাওয়া গেছে ২৭ জন। উত্তরবঙ্গের রাজধানী হিসেবে খ্যাত রাজশাহীতে চলতি বছর করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ৩২ জন। এ ছাড়া জয়পুরহাটে ২৮ জন, খুলনায় দুজন, সিলেটে দুজন, মৌলভীবাজারে দুজন করোনার রোগী পাওয়া গেছে। এদের বেশির ভাগই ওমিক্রণের নতুন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত।
যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে, কিন্তু মানছে না কেউই। জনসমাগম যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার পাশাপাশি মাস্ক ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা তুলে ধরে নির্দেশনায় বলা হয়, শ্বাসতন্ত্রের রোগগুলো থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য মাস্ক ব্যবহার করতে হবে, হাঁচি বা কাশির সময় বাহু বা টিস্যু দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখতে হবে, ব্যবহৃত টিস্যুটি অবিলম্বে ঢাকনাযুক্ত ময়লা ফেলার ঝুড়িতে ফেলতে হবে, ঘন ঘন সাবান ও পানি কিংবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে (অন্তত ২০ সেকেন্ড), অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক ও মুখ ধরা যাবে না, আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন এবং কমপক্ষে ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
এ ছাড়া সন্দেহজনক রোগীদের ক্ষেত্রে জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হলে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত বাড়িতে থাকার পরামর্শ দিয়ে বলা হয়, রোগীর নাক-মুখ ঢাকার জন্য মাস্ক ব্যবহার করতে হবে, রোগীর সেবাদানকারীরাও সতর্কতা হিসেবে মাস্ক ব্যবহার করবে, প্রয়োজন হলে কাছের হাসপাতালে অথবা আইইডিসিআর (০১৪০১১৯৬২৯৩) অথবা স্বাস্থ্য বাতায়নের (১৬২৬৩) নম্বরে যোগাযোগ করতে হবে।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রস্তুতির কথাও তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, করোনাভাইরাস নির্ণয়ের পরীক্ষা আরটি-পিসিআর, র্যাপিড এন্টিজেন টেস্ট, টিকা, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নির্দেশিকা, ওষুধ, অক্সিজেন, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, আইসিইউ, কোভিড চিকিৎসার বিশেষায়িত সুবিধাসংবলিত নির্দিষ্ট হাসপাতাল, সেবাদানকারীদের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাসামগ্রী ইত্যাদিসহ কোভিড ১৯ সংক্রান্ত সব বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রস্তুতি চলমান আছে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআর,বি) জানিয়েছে, শুধু জুন মাসের প্রথম ১০ দিনেই করোনায় সংক্রমিত হয়েছে ৩৫ জন। মৃত্যুও হয়েছে একজনের। তাই আবারও লকডাউন, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইনের দিন ফিরে আসতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রতিষ্ঠানটি আরও জানায়, এ বছরের মে মাসে কিশোরগঞ্জ, রাজশাহী, কুমিল্লা, খুলনা, যশোর, সিলেট, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও দিনাজপুরে অবস্থিত আইসিডিডিআর,বি’র হাসপাতালভিত্তিক ইনফ্লুয়েঞ্জা সার্ভিল্যান্স স্টাডি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে এই ভ্যারিয়েন্ট ৭ শতাংশ ছিল।
এমন পরিস্থিতিতে পাঁচ বছর আগের বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ রূপ নেওয়া করোনাভাইরাস ফের নতুন রূপে ফিরে আসছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় বাংলাদেশে বাড়তি সতর্কতা জোরদার করা হয়েছে। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পরামর্শ দিয়েছে সরকার।
কিন্তু ২০২০ সালের শুরু থেকে ২০২৩ সালের শেষ পর্যন্ত করোনার দৌরাত্ম্যে মানুষ যেভাবে সতর্কতা অবলম্বন করেছিল, এটি প্রতিরোধে বর্তমানে তা একেবারেই দেখা যাচ্ছে না। জনসমাগম দূরে থাক, হাসপাতালগুলোতেও কাউকে মাস্ক ব্যবহার করতে দেখা যায় না।
এ ব্যাপারে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের প্রতিষ্ঠানপ্রধান ডা. আয়েশা আক্তার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা সবাই মিলে ২০২০ সাল থেকে প্রায় ২০২৩ সাল পর্যন্ত করোনার একটা কঠিন সময় পার করেছি। তখন রোগীদের চিকিৎসায় সর্বোচ্চ চেষ্টা ছিল আমাদের। এখনো যদি রোগী বাড়ে, আমরা সেবা দেওয়ার চেষ্টা করব। কিন্তু রোগীদের মধ্যে আগের সচেতনতা নেই। এটা একটা টিবি হাসপাতাল, যা খুবই সংক্রমিত। কিন্তু এখানেও অনেক রোগীর স্বজনদের মাস্ক ছাড়া ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। অন্যান্য হাসপাতালের কী অবস্থা বোঝেন!
একই অবস্থা ঢাকা মেডিকেলেরও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন, এখন তো করোনা ওয়ার্ড বলতে আর কিছু নেই। সবকিছু স্বাভাবিক। তবে যেহেতু পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে রোগী বাড়ছে, সেহেতু আমরা মনে করছি, আমাদেরও প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। কিন্তু এই হাসপাতালে এত রোগী আসে যে অনেকটা বস্তি হাসপাতাল এটি। সবাই সুস্থতার আশায় এলেও মাস্ক ব্যবহার না করায় অন্য কোনো রোগ সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফেরে।
তিনি আরও বলেন, এখন যদি করোনার আবার বিস্ফোরণ ঘটে, তাহলে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে এ ব্যাপারেও সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই। শুধু কয়েকটা নির্দেশনা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নে কেউ কাজ করছে কি না, সে ব্যাপারে তদারকি করছে না কেউ। বিশেষ করে মফস্বল শহরগুলোতে এসব ব্যাপারে সবাই উদাসীন। আমরা কেউই চাই না ভাইরাসটি আবার বড় আকারে ফিরে আসুক। তাই সুনির্দিষ্ট একটি পরিকল্পনার ভিত্তিতে এটি প্রতিরোধে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
একই কথা বলেন হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, করোনা বা কোভিড-১৯ আবার বাড়তে শুরু করেছে। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ভাইরাসজনিত জ¦র, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত জ¦র, পানিবাহিত সংক্রমণজনিত জ্বর (যেমন টাইফয়েড) ইত্যাদি চলমান রয়েছে।
এগুলোর সঙ্গে করোনা যুক্ত হওয়ায় ভোগান্তি ও জীবনহানির সম্ভাবনা বেড়ে গেল। আমাদের পাশের দেশ ভারতে করোনা সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে। করোনার ওমিক্রন ধরনের কয়েকটি উপধরন দ্বারা এবার সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। এই উপধরনগুলোর ছড়িয়ে পড়া বা মানুষকে আক্রান্ত করার ক্ষমতা বেশি। তবে রোগের তীব্রতা তৈরির ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত কম। যে কোনো সময় এই চরিত্রের পরিবর্তন হতে পারে।
বয়স্ক মানুষ, দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগে আক্রান্ত মানুষ, শিশু, গর্ভবতী নারী এবং নানা কারণে যাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধশক্তি কম, তারাই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাই জনাকীর্ণ স্থানে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। জ¦র হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। দ্রুত সুস্থ হওয়ার জন্য জ¦রের ধরনটি শনাক্ত হওয়া জরুরি। স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব করোনাসহ সব ধরনের জ¦রকে নিবিড় নজরদারিতে রাখা এবং জনসাধারণকে সময়ে সময়ে গাইড করা।
হঠাৎ করে ঊর্ধ্বমুখী হওয়া করোনা নিয়ে প্রস্তুতি ছিল না বলে স্বীকার করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফরও। তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমরা ডেঙ্গুটা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। জানেন যে ডেঙ্গুর সংক্রমণ এরই মধ্যে ৭ হাজার ছাড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে হাসপাতালগুলোতে আলাদা ডেঙ্গু ওয়ার্ড করার সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হচ্ছে, তখন করোনার এই ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ। আমরা সংক্রমণের গতি পর্যবেক্ষণ করছি।
প্রয়োজনীয় নির্দেশনা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছে। এখন জনগণের সচেতনতা সবচেয়ে জরুরি। জনসমাগমে যেন আমরা অবশ্যই মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারি, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। আর জ¦র হলে সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করাতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :