ক্ষোভ দানা বেঁধেছে অনেক আগে থেকে। ৫ আগস্টের পর যখন সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করে সরকারি সিদ্ধান্ত আসছে, তখন সিলেট প্রশাসনের বিরুদ্ধে একের পর এক জনগুরুত্ববিরোধী সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই অভিযোগের তীর গিয়ে বিদ্ধ হয় সিলেটের জেলা প্রশাসকের ওপর। রাজনীতিক, ব্যবসায়ীসহ সব মহল থেকে নানান অভিযোগ উঠতে থাকে।
বলা হয়, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ সিলেটের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার কথা তোয়াক্কা না করে নিজের মতো সিদ্ধান্ত নেন। এতে ক্ষোভে ধীরে ধীরে ফুঁসতে থাকেন অনেকে। তবে জেলা প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি হওয়ায় কেউই মুখ খুলে কিছু বলতে পারছিলেন না। অবশ্য তা আর বেশিদিন টিকেনি।
মুখ খুলেন সিলেটের জনপ্রিয় নেতা ও সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদেরও সদস্য। গত বুধবার জেলা প্রশাসক যখন তার অফিসে পাথর কোয়ারি নিয়ে একটি মহলের সাথে বৈঠকে বসেছিলেন, ঠিক ওই মুহূর্তে বৈঠক প্রত্যাখ্যান করে বাইরে কোর্ট পয়েন্টে সমাবেশে বক্তৃতার জন্য মাইক হাতে দাঁড়ান আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি সিলেটবাসীর পালস্ বুঝে কথা বলতে শুরু করেন।
সিলেটের জেলা প্রশাসককে ‘সিলেটবিদ্বেষী’ আখ্যা দিয়ে তার প্রত্যাহার দাবি করেন। এ সময় তিনি তাকে প্রশাসনিকভাবে ‘অদক্ষ ও ব্যর্থ’ বলে মন্তব্য করেন। বিষয়টি এখন ‘টক অব দ্য সিলেট’।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ আসে পাথর কোয়ারি থেকে। সাবেক ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এলাকার মন্ত্রী ও স্থানীয় নেতাদের ব্যাবসায়িক সুবিধা রক্ষায় সিলেটের সব পাথর কোয়ারি বন্ধ রাখার অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
কোয়ারি এলাকা সিলেট-৪ আসনের তৎকালীন এমপি ও মন্ত্রী ইমরান আহমদ এবং তার নিকটজন ছাড়াও সিলেটের অনেক বড় বড় নেতা ভারতের মেঘালয় থেকে পাথর আমদানির ব্যবসায় জড়িত ছিলেন।
স্থানীয়ভাবে কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন হলে তাদের ব্যবসা ভালো যাবে না এই মতলবে তারা নানা অভিযোগ এনে পাথর কোয়ারি বন্ধ করিয়ে নেন। ভারতের ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটও এতে কলকাঠি নাড়ে।
তারা সশরীরে এসে ঢাকাকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হন। অন্যদিকে সরকারি সিদ্ধান্তে পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকলেও লুটপাট বন্ধ হয়নি। বিভিন্ন কোয়ারি থেকে মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা পাথর হরিলুট অব্যাহত রাখেন। সরকার বঞ্চিত হয় রাজস্ব থেকে।
এ অবস্থায় ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর সবাই আশায় বুক বেঁধে থাকেন, সরকারের পরিবর্তনে এবার বুঝি সবার কথা বিবেচনায় নেওয়া হবে। খুলে দেওয়া হবে সিলেটের পাথর কোয়ারি। বন্ধ হবে লুটপাট। সরকারও আর রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে না।
তখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সিলেট আসেন নতুন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ। কিন্তু তিনি আর পাথর কোয়ারি খুলে দেননি। বারবার ধর্ণা দিয়েও লাভ হয়নি। বিষয়টি শুধু চিঠি চালাচালিতেই থাকে সীমাবদ্ধ। ফলে ক্ষোভ বাড়তে থাকে।
সব রাজনৈতিক দলও সভা-সমাবেশ করে কোয়ারি খুলে দেওয়ার যুক্তি তুলে ধরে দাবি জানায় যেন পাথর কোয়ারি লিজ দেওয়া হয়। ভারতের এবং পূর্বের ফ্যাসিস্ট সরকারের মন্ত্রী ও দোসরদের স্বার্থ সংরক্ষণ না করে ব্যবসায়ী এবং স্থানীয়দের কথা ভাবার তাগাদা দেওয়া হয়।
তখন দুই উপদেষ্টা সিলেটে এসে জানান, কোনো দিনই সিলেটের কোয়ারি খুলে দেওয়া হবে না। যদিও তখন সিলেট ছাড়া দেশের বাকি কোয়ারি খুলে দেওয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সিলেটের জেলা প্রশাসন স্টোন ক্রাশার মিলের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে।
সিলগালা করার পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করা হয় ক্রাশারগুলোর। এর মধ্যে অনেক ক্রাশার মিল ভারত থেকে আমদানি করা পাথর ভাঙার কাজও করত। সব বন্ধ হওয়ায় বেকায়দায় পড়েন তারা। এতে ক্ষোভ আরও ছড়িয়ে পড়ে।
পরবর্তিতে যখন জালালাবাদ অন্ধ কল্যাণ হাসপাতালের মার্কেট জেলা প্রশাসকের নির্দেশে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো, তখন বিষয়টি নিয়ে অনেকেই জেলা প্রশাসকের সমালোচনা করেন। অভিযোগ ওঠে, জেলা প্রশাসক কারো সঙ্গে কথা না বলেই মার্কেট গুঁড়িয়ে দিয়েছেন।
সেখানে সড়কের পাশে দোকানপাট অক্ষত থাকলেও অনেক ভেতরে হাসপাতালের মার্কেটের দোকানগুলো প্রশাসন গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। বিষয়টি জানাজানি হলে তার বিরুদ্ধে ক্ষোভের মাত্রা আরও বাড়ে।
অনেকে বলছেন, জেলা প্রশাসক বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিব্রত করার জন্য কাজ করছেন। জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড় করাচ্ছেন। আর তা না হলে তিনি এসব কাজ (স্টোন ক্রাশার মিল ও কিছু স্থাপনার বিরুদ্ধে অভিযান) করার আগে প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের সাথে বসে তাদের পরামর্শ নিতেন।
তাদের প্রশ্ন, ১৭ বছর ধরে অবৈধ চোরাচালান, পাথর ও বালু তোলা অব্যাহত ছিল। যারা সেই লুটপাট করেছে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের তরফ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং ৫ আগস্টের পর সেই তারাই অবশিষ্ট পাথরও লুট করেছে। প্রশাসন কিছুই করতে পারেনি। তারা শুধু চেয়ে দেখেছে এবং লুট হওয়া পাথরের হিসাব সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। এটিই কি তাদের কাজ?
তামাবিলের একাধিক ব্যবসায়ী দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বলেন, পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় নির্মাণ কাজসহ রাস্তাঘাটের উন্নয়ন থেমে গেছে। লাখ লাখ শ্রমিক-ব্যবসায়ী আজ বেকার। সরকার সহযোগিতা না করে উল্টো কঠোর হয়েছে, এটা খুবই দুঃখজনক।
তারা জানান, বেলা কর্তৃক ২০১৭ সালে উচ্চ আদালতে একটি মামলা হয় তামাবিল থেকে ক্রাশিং মিলগুলো সরিয়ে দেওয়ার জন্য। আদালত সেগুলো বন্ধের রায় না দিয়ে দুটি নিদের্শনা দেন। এগুলো হচ্ছে, সরকার যেন বর্তমান জায়গা থেকে ক্রাশিং মেশিন সরিয়ে অন্যত্র একটি জোন করে দেয়।
যেখানে পরিবেশসম্মতভাবে ক্রাশার চালানো যায়। এরপর গোয়াইনগাট উপজেলার তামাবিলসংলগ্ন কানাইজুড়ি বিল এলাকায় একটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়। ব্যবসায়ীরাও সেখানে যেতে সম্মত হন। কিন্তু পরবর্তিতে সেটি অজ্ঞাত কারণে বাস্তবায়ন করা হয়নি।
সিলেট স্টোন ক্রাশার মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস উদ্দিন লিপু দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, পরিবেশের প্রশ্ন উঠলে আমাদের দেখতে হবে ভারত ও বাংলাদেশের দুদিক থেকে।
ভারত পাহাড়ে বোম্পিং করে পাথর কেটে সেই পাথর সরকারিভাবে আমাদের কাছে রপ্তানি করছে। সেই পাহাড় বাংলাদেশের গা-ঘেঁষে। যেখানে ক্রাশার মিল আছে সেখান থেকে দেখা যায় ভারতে পাহাড় ভাঙা হচ্ছে। তাই পরিবেশের প্রশ্ন হলে দুদেশের হবে। তাদের সীমান্তঘেঁষা পাহাড় কাটলে নিশ্চয়ই পরিবেশের যে ক্ষতি হবে, সেটি আমাদেরও প্রভাবিত করবে।
অথচ এ নিয়ে কোনো কথা নেই। আসলে পরিবেশের কিছুটা ক্ষতি হলেও আমাদের সবি কছু বিবেচনা করতে হবে। যেভাবে পরিবেশের কম ক্ষতি হয়, সেই পথে যেতে হবে। আদালত সেই নির্দেশনা দিয়েছেনও। আমরা প্রশাসনকে তা দেখিয়েছি। তারা আদালতের নির্দেশনা মানতে রাজি নন।
পাথর ব্যবসায়ীরা জানান, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংরক্ষিত এলাকাসহ জাফলং, সাদাপাথর, বিছনাকান্দি, লোভাছড়া, উৎমাসহ অন্যান্য স্থান থেকে নির্বিচারে বালু-পাথর লুট করা হয়। পাথর উত্তোলন করে ধ্বংস করা হয়েছে রেলের সংরক্ষিত এলাকা ভোলাগঞ্জ বাঙ্কার ও শাহ আরেফিনের টিলা।
অভিযোগ রয়েছে, কোয়ারিসহ বিভিন্ন স্থান থেকে কমপক্ষে দেড় হাজার কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে। আর এর পেছনে পরোক্ষ সহায়তা ও আশকারা রয়েছে প্রশাসনের।
সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, জেলা প্রশাসক আমাদেরকে বলেন, তিনি সিলেটের স্বার্থ দেখেন। কিন্তু আসলে তিনি তার উল্টো। তিনি আমাদের মধ্যে বিভাজন করার পাঁয়তারা করছেন। দুয়েকজন নেতার কথায় উঠছেন বসছেন। তাদের বশ করে তিনি মনে করছেন পার পেয়ে যাবেন। সিলেটবাসী তা হতে দেবে না। আমাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে আমরা জেলা প্রশাসককে ‘দালাল’ হিসেবে চিহ্নিত করব।
সাবেক মেয়র জানান, ডিসি পাথরসংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে বুধবার সভা ডাকেন। কিন্তু পাথরসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী কিংবা পরিবহন শ্রমিক নেতা কেউ তার বৈঠকে যাননি। সভায় অংশ নেওয়া একটি সূত্র জানায়, ওই বৈঠকে দুজন বিএনপির নেতা গেলেও বাকি সবাই ছিলেন জামায়াতের।
ক্ষুব্ধ আরিফুল হক চৌধুরী দলের নেতাকর্মী, পাথর ব্যবসায়ী, সুবিধাভোগী ও জালালাবাদ অন্ধ কল্যাণ হাসপাতালের লোকজনকে নিয়ে ‘জেলা প্রশাসক হটাও’ কর্মসূচিতে নেমেছেন। তিনি বুধবার ৫ দিন সময় বেঁধে দিয়ে এর মধ্যে ‘বিতর্কিত’ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদকে সিলেট থেকে প্রত্যাহারের আলটিমেটাম দেন। এর মধ্যে তাকে প্রত্যাহার না করলে কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবেন বলেও হুশিয়ারি দেন আরিফুল হক চৌধুরী।
বিএনপির একটি সূত্র জানায়, সিলেটবাসীর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে তার সাথে বিএনপির একটি বড় অংশ রয়েছে। জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট এবং কোম্পানীগঞ্জের বিএনপির নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সকল স্তরের মানুষ পাথর কোয়ারি খুলে দেয়ার পক্ষে। তারাও আছেন আরিফুল হক চৌধুরীর আন্দোলনের সাথে।
দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে সাবেক এই মেয়র বলেন, ডিসি এই অঞ্চলের ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নষ্ট করছেন। এমন সিলেটবিদ্বেষী জেলা প্রশাসক আমরা সিলেটে দেখতে চাই না। তাকে ৫ দিনের মধ্যে প্রত্যাহার করা না হলে কঠোর কর্মসূচি নিয়ে আমরা রাজপথে নামব।
একাধিক সূত্রের দাবি, সম্প্রতি কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়াই জেলার বিভিন্ন স্থানে পাথর ভাঙার যন্ত্রের (ক্রাশার মেশিন) ব্যবসায়ীদের বৈধ বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার কাজ শুরু করে জেলা প্রশাসন। গত দুই সপ্তাহে আড়াইশ মিলের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।
গত সোমবারও খনিজ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধি দল কোম্পানীগঞ্জে পাথর ভাঙার ১৭টি মিল ধ্বংস ও ১ লাখ ৪০ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ করে। অন্যদিকে কোনো ধরনের সময় কিংবা নোটিশ না দিয়ে নগরের মেজরটিলা এলাকায় রাস্তার পাশে থাকা বিভিন্ন স্থাপনাও উচ্ছেদ করা হয়।
তবে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ও আরিফুল হক চৌধুরীর দাবি সত্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতেই পাথর ভাঙার যন্ত্রের বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে।
এ ছাড়া সিলেট-তামাবিল আঞ্চলিক মহাসড়ক প্রশস্তকরণ কাজের অংশ হিসেবে সড়ক ও জনপথ (সওজ) তাদের জায়গায় গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নেমেছে। সরকারি কর্মকর্তারা তাদের কাজের অংশ হিসেবেই এখানে দায়িত্ব পালন করছেন। এখন হঠাৎ করে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা, আমার অপসারণ চেয়ে এমন কর্মসূচি পালন করার বিষয়টি একেবারেই দুঃখজনক।’
আপনার মতামত লিখুন :