ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এককভাবে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত জাতীয় সমাবেশ গতকাল শনিবার অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশকে কেন্দ্র করে লক্ষাধিক নেতাকর্মীর ভিড় দেখা যায় যা উদ্যান ছাড়িয়ে আশপাশের সড়ক পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
সমাবেশ থেকে জামায়াত আমিরসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারা বলেন, পুরোনো ব্যবস্থাপত্রে বাংলাদেশ আর চলবে না। সংস্কার ছাড়া নির্বাচন আয়োজনের দিকে গেলে জনগণের আকাক্সক্ষার সঙ্গে বেইমানি হবে উল্লেখ করে নেতারা বলেন, সময়োপযোগী পিআর পদ্ধতির বিরুদ্ধে যারা কথা বলেন তাদের ভিন্ন মতলব রয়েছে। তারা বলেন, আগামীর বাংলাদেশ হবে ইসলামের বাংলাদেশ সেখানে ভারতীয় আধিপত্যবাদীদের জায়গা হবে না। সমাবেশ থেকে দাবি করা হয়, গত ১৭-১৮ বছর ধরে ইসলামী শক্তির ওপর যত অত্যাচার জুলুম হয়েছে তার বিরুদ্ধে এই জনসমুদ্র গণবিস্ফোরণের সৃষ্টি। ডায়াসে বক্তব্যের এক পর্যায়ে আকস্মিক অসুস্থ হয়ে পড়েন জামায়াত আমির।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এক লড়াইয়ের পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরেক লড়াই হবে। পুরোনো ব্যবস্থাপত্রে বাংলাদেশ আর চলবে না। যারা বস্তাপচা ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশকে নিতে চান, তাদের আমরা বলি, জুলাইযুদ্ধ করে যারা জীবন দিয়েছে, আগে তাদের জীবনটা ফেরত এনে দেন। যদি শক্তি থাকে ফেরত এনে দেন। আপনারা পারবেন না। যেহেতু পারবেন না, কাজেই নতুন ব্যবস্থায় নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে ইনশাল্লাহ। এ সময় তিনি বলেন, আগামীর বাংলাদেশটা কেমন হবে? আমি বলি আরেকটা লড়াই হবে ইনশাল্লাহ। একটা লড়াই হয়েছে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, আরেকটা লড়াই হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ইনশাআল্লাহ। এই দুর্নীতির মূলোৎপাটন করার জন্য যা দরকার, আমরা তারুণ্য এবং যৌবনের শক্তিকে একত্র করে সেই লড়াইয়েও জিতব ইনশাল্লাহ।
জামায়াতের আমির বলেন, ২৪-এর জুলাই অভুত্থানে যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালার এই নেয়ামত পাওয়া তাদের যেন অবজ্ঞা এবং অবহেলা না করি। অরাজনৈতিক ভাষায় আমরা যেন কথা না বলি। যদি এগুলো আমরা পরিহার করতে না পারি, তাহলে বুঝতে হবে যারা পারবেন না, ফ্যাসিবাদের রোগ তাদের মধ্যে নতুন করে বাসা বেঁধেছে। তিনি বলেন, আমাদের প্রিয় শহীদ নেতৃবৃন্দ, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু করে, শাপলা গণহত্যা, সারা দেশের গণহত্যা, চব্বিশের গণহত্যা যারা করেছে, তাদের সবার বিচার বাংলাদেশের মাটিতে নিশ্চিত করতে হবে। এদের বিচারের দৃশ্যমান প্রক্রিয়া শুরু না করা পর্যন্ত পুরোনো ব্যবস্থাপত্রে বাংলাদেশ আর চলবে না।
ডায়াসে বক্তব্যের একপর্যায়ে তিনি আকস্মিক অসুস্থ হয়ে পড়ে যান। মঞ্চে থাকা নেতারা তাকে ধরাধরি করে তোলেন। মিনিটখানেক অপেক্ষা করে ডা. শফিকুর আবার বক্তব্য শুরু করেন। কিন্তু আবার তিনি পড়ে যান। এরপর মঞ্চে থাকা দলের নেতারা তাকে ধরে বসান। খানিকটা সময় অপেক্ষা করে মঞ্চে ডায়াসের পাশে পা মেলে বসেই বক্তব্য দিতে শুরু করেন জামায়াত আমির। সমাবেশ শেষে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
দলের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, জনসমুদ্র গণবিস্ফোরণের সৃষ্টি করেছে। ১৭-১৮ বছর ধরে জামায়াতে ইসলামী তথা ইসলামী শক্তির ওপর যত অত্যাচার জুলুম হয়েছে তার বিরুদ্ধে এই জনসমুদ্র গণবিস্ফোরণের সৃষ্টি।
দলের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, পিআর পদ্ধতিতে কেন্দ্র দখল বা টাকা দিয়ে ভোট কেনা যাবে না বলে অনেকে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন চান না। জামায়াতে ইসলাম কোনো সন্ত্রাসবাদকে পছন্দ করে না। জামায়াতে ইসলামে জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কোনো জঙ্গিবাদই দেশে মাথাছাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। জামায়াতে ইসলাম জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, লড়াই করবে, প্রয়োজনে সংগ্রাম করবে।
সমাবেশে অংশ নিয়ে গণঅধিকার পরিষদ সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, দেশে শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মৌলিক সংস্কার ছাড়া জাতীয় নির্বাচনের দিকে হাঁটা যাবে না। আল্লাহ মানুষকে ধন, সম্পদ ও ক্ষমতা দিয়ে পরীক্ষা করেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, বিপদ কেটে গেলে মানুষ অহংকারী হয়ে পড়ে। যারা জালিমের বিরুদ্ধে লড়েছে, তারাই যেন আবার জালিম না হয়ে ওঠে। শেখ হাসিনার মতো সীমা লঙ্ঘন করলে আমাদেরও আল্লাহ রেহাই দেবেন না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, রক্তের বিনিময়ে যে ঐতিহাসিক পরিবর্তন এসেছে, তা টেকসই করতে হলে মৌলিক শাসনতান্ত্রিক সংস্কার জরুরি। সেই সংস্কার না করে নির্বাচন আয়োজনের দিকে এগিয়ে যাওয়া জনগণের আকাক্সক্ষার সঙ্গে বেইমানি হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, গণতন্ত্রের সুরক্ষায় সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন প্রবর্তন করতে হবে। বাংলাদেশে শুধু নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্রের সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দিতে হলে নির্বাচনের আগেই মৌলিক সংস্কার করতে হবে এবং ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্য উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে।
এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদীদের জায়গা হবে না। আমরা অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারকে সুশীল সরকার দেখতে চাই না। আমাদের নারীদের অধিকার ও সখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিকে ঐক্য থাকতে হবে। তবে কেউ চাঁদাবাজি করলে আমরা সেটা বলব।
সমাবেশে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ড. ফয়জুল হক বলেন, আলেম-ওলামাদের মধ্যে বৈষম্য দেখতে চাই না। সমগ্র বাংলাদেশে রাজনৈতিক ঐক্য গড়তে হবে। আগামীর বাংলাদেশ কালেমার বাংলাদেশ, আগামীর বাংলাদেশ ইসলামের বাংলাদেশ। আগামীর বাংলাদেশে চাঁদাবাজ, সন্ত্রাস, পাথর দিয়ে মানুষ হত্যা মেনে নেওয়া হবে না। আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ২০১৩ সালে নিজামি, সাঈদী, মুজাহিদ, কাদের মোল্লাসহ যাদের হত্যা করা হয়েছে, সেই রক্তের জবাব দিতে হবে। তিনি বলেন, অনেকেই নতুন করে নাটক শুরু করেছে। রাজাকার ট্যাগ লাগানোর দিন শেষ হয়ে গেছে। বাংলাদেশে এখন থেকে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরে যারা এ রাজাকার শব্দ উচ্চারণ করে ইসলামের ঐতিহ্যকে ধ্বংসের দিকে নেবে, তাদের দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হবে। এর জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
জামায়াতে ইসলামীর ৭ দফা বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলন সমর্থন করে বক্তব্য দেন ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমদ। এ ছাড়াও সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসবিচ মুসা বিন ইজহার, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) সহ-সভাপতি ও দলীয় মুখপাত্র রাশেদ প্রধান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা, শহীদ পরিবারের স্বজনেরা।
উল্লেখ্য, সাত দফা দাবিতে অনুষ্ঠিত হয় জামায়াতের গতকালের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। দাবিগুলো হলোÑ অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতকরণ, সব গণহত্যার বিচার, প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার, ‘জুলাই সনদ’ ও ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন, জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারের পুনর্বাসন, সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন ও এক কোটির বেশি প্রবাসী ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ। গতকাল দুপুর ২টায় কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সমাবেশের মূল কার্যক্রম শুরু হয়। এর আগে গতকাল সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় সমাবেশের প্রথম পর্ব শুরু হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন সাইফুল্লাহ মানসুর। সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করে। নেতাকর্মীদের অনেকের হাতে তাদের দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা দেখা যায়। দাঁড়িপাল্লা ও দলীয় মনোগ্রাম সম্বলিত টি-শার্ট ও পাঞ্জাবি পরে আসে হাজারো নেতাকর্মী।