দীর্ঘ আলোচনার পর বহু প্রত্যাশিত ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ ঘোষণাপত্রের খসড়া চূড়ান্ত করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এতে ১৯৭২ সালের সংবিধান সংশোধন প্রয়োজনে তা বাতিল করার পরিকল্পনা জানানো হয়েছে। ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, এই দলিল ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে কার্যকর ধরা হবে।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে আয়োজিত বৈঠকে এই খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা অংশ নেন।
অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, কিন্তু দৃঢ় উদ্যোগ: ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ এবং ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ এই দুটি দলিল আগামী দিনের বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় চিন্তাধারাকে আমূল প্রভাবিত করতে পারে। তবে এগুলোর বাস্তবায়ন নির্ভর করবে রাজনৈতিক সমঝোতা, অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা কাঠামো এবং ভবিষ্যৎ নির্বাচনের রূপরেখার ওপর।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই প্রক্রিয়া শুধু একটি ঐতিহাসিক পর্বের সমাপ্তি নয়, বরং নতুন যুগের সূচনা হতে পারে। যদি তা কার্যকর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়।
জুলাই ঘোষণাপত্রের মূল বক্তব্য: চূড়ান্ত ঘোষণাপত্রের খসড়ায় স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা তুলে ধরা হয়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীকালে রাজনৈতিক অনিয়মের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী ব্যবস্থায় জাতিকে নতুন দিশা দেওয়ার লক্ষ্যে ঘোষণাপত্রটি রচিত হচ্ছে বলেও এতে দাবি করা হয়।
খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘আমরা, ছাত্র-জনতা সেই অভিপ্রায়বলে আত্মমর্যাদা, সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারের যে আদর্শে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে, সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য সার্বভৌম জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের সংগঠিত করিলাম।’
এতে আরও বলা হয়, ‘আমরা ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারকে লালন করার দলিল ১৯৭২ সালের সংবিধান সংশোধন বা প্রয়োজনে বাতিল করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম।’
ঘোষণাপত্রের খসড়ায় ২৬টি দফা রয়েছে। প্রথম ২১ দফায় মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের মানুষের অতীতের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম থেকে শুরু করে জুলাই অভ্যুত্থানের পটভূমি বর্ণনা করা হয়েছে। পরের ৫টি দফায় রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কারের আকাঙ্খা, আওয়ামী লীগ শাসনামলে গুম-খুন, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও সব ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুণ্ঠনের অপরাধের দ্রুত উপযুক্ত বিচার, আইনের শাসন ও মানবাধিকার, দুর্নীতি, শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে।
নতুন ‘রিপাবলিক’-এর ডাক: ঘোষণাপত্রে ‘নতুন জনতন্ত্র’ বা রিপাবলিক গঠনের কথা বলা হয়েছে, যা হবে বৈষম্য, নিপীড়ন ও রাজনৈতিক শোষণমুক্ত। ঘোষণায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত ‘গণহত্যা ও রাষ্ট্রীয় লুটপাটের’ বিচার নিশ্চিত করারও আহ্বান জানানো হবে। ঘোষণাপত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে রাজনৈতিক সংস্কার, সংসদ বিলুপ্তি এবং নতুন সাংবিধানিক কাঠামোর দাবি স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছে।
ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়, ‘আমরা এই ঘোষণা প্রদান করলাম যে ১৯৭২ এবং ১/১১ কালের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তন ঘটানোর জন্য আমাদের একটি নতুন জনতন্ত্র (রিপাবলিক) প্রয়োজন।’
ঘোষণাপত্রের প্রকাশ ৫ আগস্ট শহিদ মিনারে: প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, আগামী মঙ্গলবার বিকেল ৫টায় ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তির দিনে এই ঘোষণার প্রতীকী তাৎপর্য রয়েছে বলে বিশ্লেষকদের মত।
প্রথমে এই ঘোষণাপত্রের উদ্যোগ সরকার থেকে আসেনি। বরং ২০২৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি একযোগে এ প্রস্তাবনা তোলে এবং ৩১ ডিসেম্বর শহিদ মিনারে এর ঘোষণা দেওয়ার কর্মসূচি নেয়। পরে অন্তর্বর্তী সরকার একে নিজেদের উদ্যোগে পরিণত করে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের ঘোষণা: এদিকে গতকাল শনিবার দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট দিয়ে জানান, ‘অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া চূড়ান্ত করেছে। আগামী মঙ্গলবার, ৫ আগস্ট, ২০২৫ বিকেল ৫টায় গণঅভ্যুত্থানের সকল পক্ষের উপস্থিতিতে জুলাই ঘোষণাপত্র জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে। এ বিষয়ে বিস্তারিত অবিলম্বে ঘোষণা করা হবে।’
রাজনৈতিক সংলাপ ও ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ : ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রণয়নের পাশাপাশি রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারে চলমান জাতীয় সংলাপের ফসল হিসেবে প্রস্তুত হচ্ছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’। ২৩ দিনের দীর্ঘ সংলাপ শেষে ৩০টি দল ও জোটের সঙ্গে ১৯টি বিষয়ে আলোচনা সম্পন্ন করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেন, এই সংলাপ বাংলাদেশের ইতিহাসে ব্যতিক্রমধর্মী একটি উদ্যোগ। শতভাগ ঐকমত্য পাওয়া কল্পনা হতে পারে, তবে আমরা আটটি মৌলিক বিষয়ে একমত হতে পেরেছি, এটিই বড় অর্জন।
যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য: কমিশন সূত্রে জানা গেছে, যে আটটি বিষয়ে পূর্ণ রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে- সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্বে বিরোধী দলের নেতৃত্ব, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদানের ক্ষমতা সীমিত করা, জরুরি অবস্থা ঘোষণায় কাঠামোগত সংস্কার, সংবিধান সংশোধনের জন্য আইন প্রণয়ন, প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ দুইবারে সীমাবদ্ধ করা, পুলিশ কমিশন গঠন এবং মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের গ্যারান্টি দেওয়া। এই আটটি সিদ্ধান্তকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর কেন্দ্রীয় স্তম্ভ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
যেসব বিষয়ে মতানৈক্য ও আপত্তি : বাকি ১১টি প্রস্তাবে বিভাজন রয়ে গেছে। বিএনপি, সিপিবি, বাসদ, জাসদ ও জামায়াতে ইসলামীর মতো দলগুলো আপত্তি জানিয়েছে- নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে ভিন্নমত। উচ্চকক্ষ গঠনের বিরোধিতা। রাষ্ট্রপতির নিয়োগক্ষমতা বৃদ্ধিতে আপত্তি। দুদক, পিএসসি ও মহাপরীক্ষকের স্বশাসন। নারী আসনে বাধ্যতামূলক নির্বাচনের হার এবং নতুন সাংবিধানিক মূলনীতি সংযোজন ইত্যাদি।
আপনার মতামত লিখুন :