একসময়ের নিরিবিলি ও শান্তিপূর্ণ খুলনা শহর ক্রমেই পরিণত হচ্ছে আতঙ্কের নগরে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ভেঙে পড়েছে মহানগরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। প্রতিনিয়ত ঘটছে খুন, গুলি ও কুপিয়ে জখমের মতো ঘটনা।
আগস্ট মাসের পাঁচ দিনেই দুজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এতে উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। দৃশ্যমান হচ্ছে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি। এসব ঘটনার মোটিভ উদঘাটন এবং কিছু আসামি আটক হলেও প্রকৃত সন্ত্রাসীরা ধরা পড়েনি। চিহ্নিত খুনিরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত অষ্টম মাসে খুলনা মহানগরে খুনের ঘটনা ঘটেছে ১৮টি। আর গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ৩১টি হত্যা মামলা রুজু হয়েছে। এই ৩১টি হত্যা মামলায় পুলিশ ১৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করলেও প্রকৃত অপরাধীরা এখনো অনেকাংশেই ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর চলতি বছরে ১৮টি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে ৬৯ জন। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত একই সময়ে হত্যা মামলার সংখ্যা ছিল ১৯।
নগরবাসীর ভাষ্যমতে, আগে খুলনায় রাতে হাঁটতে ভয় ছিল না। এখন সন্ধ্যার পরই আতঙ্ক ঘিরে ধরে। গেল ৪৮ ঘণ্টায় দুটি হত্যাকা- ও একজন গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে স্থানীয়রা। প্রকৃত সন্ত্রাসীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত ১ আগস্ট রাতে সোনাডাঙ্গায় নিজ বাড়িতে ছুরিকাঘাতে খুন হন মনোয়ার হোসেন টগর। গত রোববার রাতে কাস্টম ঘাটে যুবক সোহেলকে গুলি করে মুখোশধারীরা। সোহেল আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। একই রাতে মহেশ্বরপাশায় ঘের ব্যবসায়ী আল আমিনকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তিনটি ঘটনায়ই এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এ ছাড়া গত ১১ মাসে খুলনায় গুলি ও কুপিয়ে গুরুতর জখম করার মতো শতাধিক ঘটনা ঘটেছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ডিসিপ্লিনের সহকারী অধ্যাপক মো. আসাদুজ্জামান বলেন, সম্প্রতি খুলনা শহরে সহিংস অপরাধ, যেমনÑ হত্যাকা-, চাঁদাবাজি এবং কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বেড়েছে, যা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যকর ভূমিকার অভাবকে নির্দেশ করে। বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা এবং কিছু ক্ষেত্রে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় সাধারণ মানুষ আইনের শাসনের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, দ্রুত বিচার ও সুশাসন ছাড়া এই পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়।
কেএমপির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত খুলনা মহানগরীতে ৩১টি হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩টি হত্যা মামলা হয়েছে। আর চলতি বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসে হত্যা মামলা দুটি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে একটি করে, এপ্রিলে দুটি, মে মাসে হয়েছে পাঁচটি, জুনে তিনটি, জুলাইয়ে দুটি এবং আগস্ট মাসে এ পর্যন্ত হত্যার শিকার হয়েছেন দুজন। চলতি বছরে নগরীর আটটি থানার মধ্যে খুলনা সদর ও সোনাডাঙ্গা মডেল থানায় জানুয়ারিতে প্রথম হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে। মে মাসে সবচেয়ে বেশি খুন হয় খুলনা মহানগরে।
জানুয়ারিতে সদর থানা ও সোনাডাঙ্গা থানা এলাকায় দুজন, ফেব্রুয়ারিতে সোনাডাঙ্গা থানা এলাকায় একজন, মার্চে সদর থানা এলাকায় একজন, এপ্রিলে সদর থানা এলাকায় ও আড়ংঘাটা থানা এলাকায় দুজন, মে মাসে সদর থানা ও সোনাডাঙ্গা থানা এলাকায় একজন, লবণচরা থানা এলাকায় দুজন ও হরিণটানা থানা এলাকায় একজন খুন হন। জুন মাসে সোনাডাঙ্গায় একজন ও হরিণটানা থানা এলাকায় খুন হন দুজন। আর জুলাই মাসে সদর ও দৌলতপুরে দুজন খুন হন।
তবে এসব ঘটনায় বেশির ভাগই আসামি গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে। তবে আসামিরা আদালতের মাধ্যমে জামিনে বের হয়ে আবারও একই ধরনের অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
খুলনার নাগরিক সমাজের সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, ‘এসব অপরাধের পেছনে আধিপত্য বিস্তার, পূর্ববিরোধ, মাদকসংশ্লিষ্টতা ও রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ার বিষয়গুলো বড় ভূমিকা রাখছে। অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছি।’ তিনি আরও বলেন, খুলনার পুলিশ প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনতে এখন চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। সাধারণ মানুষ হিসেবে এমন অবস্থা কাম্য নয়।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার (মিডিয়া) খন্দকার হোসেন আহমদ বলেন, ‘খুলনাবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমরা টহল বাড়িয়েছি, বিশেষ চেকপোস্ট দিয়েছি শহরের বিভিন্ন জায়গায়। এ ছাড়া যে খুনগুলো হচ্ছে, এগুলোর বেশির ভাগই টার্গেট কিলিং। আমরা প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের অল্প সময়ের মধ্যেই গ্রেপ্তার করেছি।’ তিনি আরও বলেন,‘ আমরাও বিষয়গুলো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছি। আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। সম্প্রতি শহরে দুটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি ঘটনায় পুলিশের একাধিক টিম তদন্ত করছে। খুব শিগগির আসামিরা গ্রেপ্তার হবে বলে আশা প্রকাশ করছি।’
আপনার মতামত লিখুন :