রাজশাহী নগরীর শ্রীরামপুর এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধের পাশের বস্তিতে বাস করে শত পরিবার। সরেজমিনে দেখা যায়, পদ্মা নদীর পানি এসে ঢুকেছে বাড়িঘরে। বস্তির বাসিন্দা মোতাহার হোসেন বলেন, ‘আমরা শহরেই থাকি, কিন্তু বাস করি গ্রামের মতো। নদীতে পানি বাড়লেই ঘরবাড়ি ডুবে যায়। এটা আমাদের প্রতিবছরের দুর্ভোগ।’
রাজশাহী নগরের পঞ্চবটি খড়বোনায় বন্যার পানি ঘরে ঢুকেছে। এটি রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকাতেই। পদ্মার পানি বৃদ্ধির ফলে সেখানে অনেকের বাড়িতেই এখন হাঁটুপানি। বস্তিবাসী মাজেরা বলেন, ‘এক সপ্তাহ ধইরি পানির ভেতরেই আছি বাপ। কিছু তো করার নাই। তাকায় আছি, কবে পানি নামবি। পানিত থাইকি হাত-পাও সব ঘা হয়ে গেল। খালি চুলকায়।’
শহরের দক্ষিণে পদ্মা নদী পাড়ের এ বস্তির মানুষ ভাবছেন, নদীর পানি কমলেই স্বস্তি পাবেন তারা। কিন্তু শহরের উত্তর প্রান্তের কিছু বস্তির মানুষের ভয় আকাশের বৃষ্টি। একটু বৃষ্টি হলে তাদের বাড়িঘরেও পানি জমে যায়। রাজশাহীতে এবার বৃষ্টি বেশি হচ্ছে। তাই লম্বা সময় ধরেই অসংখ্য বাড়িতে পানি জমে আছে। উন্নয়নের জোয়ারে মধ্যশহরে চাকচিক্য এলেও শহরতলির এ বস্তিগুলোয় ড্রেনও নির্মাণ হয়নি। ফলে বাসিন্দারা আছেন দুর্ভোগে।
রাজশাহী শহরের জন্য পদ্মার পানির বিপৎসীমা ১৮ দশমিক ০৫ মিটার। গত বুধবার সকাল ৯টায় পানির উচ্চতা পাওয়া যায় ১৭ দশমিক ৪৯ মিটার। গতকাল শুক্রবার বেলা ২টা পর্যন্ত পানির পরিমাপ একই ছিল। নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে বিপৎসীমার মাত্র ৫৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে। পদ্মাপাড়ের বস্তিগুলোর মানুষেরা নদীর পানি কমে যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে আছেন।
এদিকে আবহাওয়া অফিস বলছে, রাজশাহীতে এবার বর্ষা মৌসুমে অন্য বছরের তুলনায় বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। গেল মে মাসে এখানে ২৯৭ দশমিক ৮ মিলিমিটার, জুনে ২১৪ দশমিক ৮ মিলিমিটার এবং জুলাইয়ে ৩৮০ দশমিক ৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া গত বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ১৬২ দশমিক ৭ মিলিমিটার। এতে শহরের বিভিন্ন এলাকায় পাড়া-মহল্লার মানুষ ও বস্তিবাসীকে চরম দুর্ভোগে দিন কাটাতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বস্তিশুমারি অনুযায়ী, রাজশাহী নগরে বস্তির সংখ্যা ১০৪টি। প্রায় ৮১ শতাংশ পরিবার ঝুপরি বা ছোট টিনের ঘরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করেন। বর্ষাকালে বৃষ্টির ফলে তাদের বেশির ভাগেরই বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করে। ডুবে যায় চলাচলের রাস্তা। মধ্য শহরের উন্নয়নে যেভাবে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে, সেভাবে গুরুত্ব পায়নি শহরতলির এসব বস্তি ও পাড়া-মহল্লা। পর্যাপ্ত ড্রেন নির্মাণ না হওয়ায় সেখানে পানি জমে থাকে।
নগরের আমচত্বরসংলগ্ন রায়পাড়া এলাকায় দেখা যায়, বৃষ্টির কারণে এলাকার বাতেনের বিল পানিতে ভেসে গেছে। পানি ঢুকে পড়েছে আশপাশের বস্তিতে। কোমরসমান পানি মাড়িয়ে বাড়ি যাতায়াত করেন কুরবান আলী। তিনি বলেন, ‘এলাকায় বৃষ্টির পানি ড্রেন দিয়ে অন্য কোনো দিকে যাওয়ার ব্যবস্থা নাই। সব পানি বিলে নামে। বিল একসময় ভরে যায়। তারপর পানি ঢুকে আটকে থাকে বাড়িতে বাড়িতে। বছরের পর বছর আমরা দুর্ভোগের মধ্যে আছি। সিটি করপোরেশন হলেও কেউ আমাদের খোঁজ নেয় না।’
নগরের বড়বনগ্রাম এলাকায় অনেক বাড়িতে বৃষ্টির পানি জমে আছে। এলাকার বাসিন্দা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সব উন্নয়ন শুধু সাহেববাজার আর রেলগেট এলাকায়। আমরা সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা হলেও এদিকে কারো খেয়াল নাই। এদিকে লাইট জ¦লে না। ড্রেন নাই। বৃষ্টির পানিতেই আমাদের হাবুডুবু খেতে হয়। ট্যাক্স ঠিকই দিচ্ছি, সেবা পাচ্ছি না। মেয়র-কাউন্সিলরও কেউ নাই যে কাউকে গিয়ে আমাদের দুর্ভোগের কথা বলে আসব।’
সামাজিক সংগঠন রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. জামাত খান বলেন, ‘রাজশাহীর মধ্যশহরে উন্নয়নের কমতি নেই, কিন্তু শহরলাগোয়া এলাকাগুলো পিছিয়ে আছে। বড় প্রকল্প পড়ে আছে, টাকা পড়ে আছে, কিন্তু কেন জানি শহরের আশপাশের এলাকাগুলোর উন্নয়ন করা হয়নি। তারা শুধু ট্যাক্স বাড়ানোর দিকেই মনোযোগ দিয়ে রেখেছে। এটা তো চলতে পারে না। উন্নয়নটা যেন সুষম হয়, সেটা দেখতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আহমদ আল মঈন ও নির্বাহী প্রকৌশলী (উন্নয়ন) মাহমুদুর রহমানকে কয়েক দফা ফোন করা হলেও কোনো সাড়া দেননি।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন