জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের মধ্যে ৮২ দশমিক ৫ শতাংশ মারাত্মক বিষণœতায় ভুগছেন এবং ৬৪ শতাংশ তীব্র আঘাত-পরবর্তী মানসিক চাপে (পিটিএসডি) আক্রান্ত হয়েছেন বলে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) একটি গবেষণায় উঠে এসেছে।
গতকাল সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের এ-ব্লক অডিটোরিয়ামে আয়োজিত সেন্ট্রাল সেমিনারে এ তথ্য প্রকাশিত হয়। ‘বিয়ন্ড দ্য হেডলাইনস : মেন্টাল হেলথ কন্সিকোয়েন্সেস অব দ্য জুলাই আপরাইজিং অ্যান্ড মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি’ শীর্ষক এই সেমিনারের আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল সেমিনার সাব-কমিটি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সাব-কমিটির চেয়ারপার্সন অধ্যাপক ডা. আফজালুন নেসা এবং সঞ্চালনা করেন সদস্যসচিব সহযোগী অধ্যাপক ডা. খালেদ মাহবুব মোর্শেদ মামুন। সেমিনারে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মনোরোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. নাহিদ মাহজাবিন মোর্শেদ ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শামসুল আহসান।
এ সময় ‘ইম্প্যাক্ট অব ট্রমা অ্যান্ড ভায়োলেন্স এমং চাইল্ড অ্যান্ড এডোলোসেন্ট পপুলেশন’ শীর্ষক বৈজ্ঞানিক উপস্থাপনায় অধ্যাপক ডা. নাহিদ মাহজাবিন মোর্শেদ উল্লেখ করেন, শৈশবের ট্রমা ও সহিংসতা শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তকরণ ও দ্রুত মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা দিলে দীর্ঘমেয়াদি মানসিক রোগ ও আচরণগত সমস্যাগুলো প্রতিরোধ করা সম্ভব।
তিনি বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তারা শিশুর মানসিক অবস্থা মূল্যায়ন করেন, সাইকোলজিক্যাল ফার্স্ট এইড প্রদান করেন, প্রমাণভিত্তিক থেরাপি প্রয়োগ করেন, প্রয়োজনে ওষুধ ও অন্যান্য চিকিৎসাব্যবস্থা সমন্বয় করেন এবং পরিবার, শিক্ষক ও কমিউনিটিকে নিয়ে সমন্বিত সহায়তাব্যবস্থা গড়ে তোলেন। প্রকৃতপক্ষে সহানুভূতিশীল পরিবার, সচেতন শিক্ষক এবং নিরাপদ সমাজ একসঙ্গে কাজ করলে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য শক্তিশালী সুরক্ষা তৈরি হয়। অভিভাবক, শিক্ষক ও যতœদাতাদের আহ্বান জানাই, শিশুর মানসিক কষ্ট বা পরিবর্তন লক্ষ করলে দেরি না করে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। দ্রুত হস্তক্ষেপ মানে ভবিষ্যতের জটিলতা প্রতিরোধ। মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীরা শুধু চিকিৎসকই নন, তারা শিশুদের জন্য সহায়ক, পথপ্রদর্শক এবং ভবিষ্যৎ রক্ষাকারী।
এদিকে সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শামসুল আহসান তার ‘মেন্টাল হেলথ ইম্প্যাক্ট অব ভায়োলেন্স অ্যান্ড ট্রমা’ শীর্ষক বৈজ্ঞানিক উপস্থাপনায় জানান, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের মধ্যে বিএমইউ, নিটোর এবং এনআইইউতে ভর্তি হওয়া ২১৭ জন রোগীর মধ্যে বিষণœতার হার ৮২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে ভোগা মানুষের হার ৬৪ শতাংশ।
তিনি বলেন, আহতদের মধ্যে অনেকেই বিষণœতা ও তীব্র আঘাত-পরবর্তী মানসিক চাপÑ এই উভয় সমস্যায় ভুগছেন। আহতদের মধ্যে যারা গ্রামীণ এলাকার রোগী, তারা নিজেদের বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেন এবং তারা অধিক মাত্রায় উদ্বিগ্ন। কারণ তাদের ধারণা, হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়ার পরে তারা যথাযথ চিকিৎসাসেবা পাবেন না। সে কারণে সর্বজনীন শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা ঢাকা ও ঢাকার বাইরে তৈরি করা জরুরি।
ডা. আহসান আরও উল্লেখ করেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত ও মানসিকভাবে বিপর্যস্তদের জন্য ইতিমধ্যে বিএমইউ, ডিএমসিএইচ, এনআইএমএইচ, সাজেদা ফাউন্ডেশন ও ব্র্যাকের সমন্বয়ে একটি বিশেষ মানসিক স্বাস্থ্য টিম গঠন করা হয়েছে। এই বিশেষজ্ঞ টিম প্রাথমিক প্রতিরোধের ওপর কাজ করছে, বিশেষ করে যাদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা এখনো তৈরি হয়নি, তাদের মানসিকভাবে সুরক্ষিত রাখতে মনোনিবেশ করছে। এ জন্য কাউনসেলিং, গ্রুপ সেশন ও প্রয়োজনে কিছু ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে। যারা ইনজ্যুরড বা গুরুতর বার্ন ভিকটিম, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা নিরূপণ করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আগে থেকেই যদি কারও মানসিক সমস্যা থাকে, তাহলে সেটি যাতে আর বাড়ে সেদিকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি জানান, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শিকারদের মানসিক সহায়তার জন্য হটলাইনে সেবা দেওয়ার কার্যক্রমও শুরু হয়েছে এবং বিএমইউর ডাক্তাররাও এর অংশ। সবার ও সব প্রচেষ্টার একটাই লক্ষ্য, আহতদের সাইকোথেরাপিসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা।
এ ছাড়া সেমিনারে মূল্যবান বক্তব্য রাখেন বিএমইউর সম্মানিত কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নাহরীন আখতার। তিনি বলেন, ট্রমা, ভায়োলেন্স, সেই সঙ্গে মেন্টাল ইলনেস প্রতিরোধের জন্য পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা প্রয়োজন। একই সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যকে অবহেলা না করে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে আর দায়িত্ববান ও যতœশীল হতে হবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন