এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল সিআইসির অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, বাংলাদেশ থেকে পাচার বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তোলা হয়েছে। মাত্র পাঁচটি দেশের সাতটি শহরে এই অবৈধ সম্পদের সন্ধান মিলেছে। এটি নিঃসন্দেহে ‘টিপ অব দ্য আইসবার্গ’। আসল চিত্র আরও ভয়াবহ হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
সিআইসির এই তথ্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক সেই সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত।
এই বিপুল অর্থ ও সম্পদ আসলে দেশের শ্রমজীবী মানুষের রক্ত-ঘামে অর্জিত। দেশের উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগের পরিবর্তে তা লুটপাট করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এটি নিছক দুর্নীতি নয়, অর্থনীতিকে ধ্বংস করার এক ধরনের দেশদ্রোহিতা। এই অবস্থায় সরকার, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), এনবিআর, সিআইডি এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সমন্বিতভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
আরও বিস্ময়কর বিষয় হলো, পাচারকারীরা বিদেশি নাগরিকত্ব ও পাসপোর্টও কিনেছে। ৯টি দেশে ৩৫২টি পাসপোর্টের সন্ধান পাওয়া গেছে। অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারমুডা, গ্রেনেডা, তুরস্ক কিংবা অস্ট্রিয়ার মতো দেশে বাংলাদেশের নাগরিকরা টাকার বিনিময়ে নাগরিকত্ব অর্জন করেছে, যা জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি। এমনকি তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেটাবেজ নিয়ন্ত্রণে নিজেদের লোক বসিয়ে তথ্য গায়েব করার মতো ভয়াবহ অপরাধও সংঘটিত করেছে।
এই বাস্তবতা প্রমাণ করে, অর্থপাচারকারীরা শুধু রাষ্ট্রের সম্পদ লুট করেনি, তারা রাষ্ট্রের ভিতকেও নড়বড়ে করেছে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমরাও বলতে বাধ্য হচ্ছি, এটি ভয়াবহ দেশদ্রোহিতার শামিল।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি এই অপকর্মের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারব? নাকি আগের মতোই সময়ের গর্ভে হারিয়ে যাবে? এর উত্তর একটাই, রাষ্ট্রকে দ্রুত কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সিআইসি, দুদক, সিআইডি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে হবে। একই সঙ্গে অপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
অর্থপাচার শুধু অর্থনৈতিক অপরাধ নয় বরং এটি সামাজিক বৈষম্য, নৈতিক অবক্ষয় ও প্রজন্মের ভবিষ্যৎ ধ্বংসের অন্যতম কারণ। কয়েকজন সুবিধাভোগী লুটেরা দেশের সম্পদ বিদেশে সরিয়ে নিচ্ছে, আর দেশের কোটি কোটি মানুষকে দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতির যন্ত্রণায় ভুগতে হচ্ছে। এ ধরনের বৈপরীত্য কোনো রাষ্ট্রে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে না।
আমরা মনে করি, সরকার সব সংস্থাকে জোটবদ্ধ করে পাচারকারীদের মুখোশ উন্মোচন করবে এবং জাতির সামনে সত্য প্রকাশ করবে। জনগণ জানতে চায়, কারা দেশের সম্পদ লুট করেছে, কীভাবে করেছে এবং কেন এতদিন তাদের ধরা যায়নি।
অতীতে আমরা দেখেছি, অনেক অনুসন্ধান শুরু হলেও তা চাপ ও প্রভাবের কারণে ধামাচাপা পড়ে গেছে। এবার সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি চলবে না। জনগণ প্রত্যাশা করে, এই অর্থ ফিরিয়ে এনে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান খাতে ব্যবহার করা হবে।
দেশের ভবিষ্যৎ রক্ষায় পাচারের অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ যেন শুধু কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং বাস্তবে রূপ পায়। তা না হলে দেশপ্রেমিক প্রজন্মের কাছে সরকারকে দায়বদ্ধ হয়ে থাকতে হবে সেই সঙ্গে রাষ্ট্রের অর্থনীতি নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে বাধাগ্রস্ত হবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন