ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সংসদীয় আসনের সীমানা নিয়ে আপত্তি শুনানিতে দুই পক্ষের মধ্যে হট্টগোল, হাতাহাতি ও মারামারির ঘটনা ঘটেছে। গতকাল রোববার দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অন্য কমিশনারদের উপস্থিতিতেই এ ঘটনা ঘটে। এদিন নির্বাচন ভবনের অডিটোরিয়ামে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও ৩ আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে শুনানি শুরু হয়। শুনানির প্রথম দিনই মারামারির ঘটনা ঘটে।
ঘটনার একপর্যায়ে বিএনপি নেত্রী ও সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাকে শারীরিকভাবে হেনস্তা ও ধাক্কা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ করতে হয়। পরে হট্টগোলের কারণে সংশ্লিষ্ট আসন দুটির শুনানি সংক্ষিপ্ত করে বিবদমান পক্ষগুলোকে সভাকক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়।
পরে দুপুর ১২টায় ইসি সচিবালয়ের মিলনায়তনে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে আপত্তির শুনানি শুরু হয়। শুনানিতে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন, চার নির্বাচন কমিশনার ও ইসি সচিব উপস্থিত ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও ৩ আসনের সীমানা নিয়ে শুনানির একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়, যা পরে হাতাহাতি ও মারামারিতে রূপ নেয়।
শুনানিতে অংশ নিয়ে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা সীমানা পুনর্নির্ধারণের খসড়া প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী এক নেতার অনুসারীরাসহ বেশ কয়েকজন খসড়ার বিরোধিতা করেন। তাদের দাবি, বিজয়নগর উপজেলাকে অখ- রাখতে হবে। বিজয়নগরের তিনটি ইউনিয়নকে (বুধন্তি, চান্দুরা ও হরষপুর) ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে যুক্ত করার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন তারা।
এই উত্তেজনা নির্বাচন ভবনের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। সেখানেও দুই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে হট্টগোল শুরু হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সদস্যরা এক পক্ষকে ফটকের সামনে থেকে সরিয়ে দেয়। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে নির্বাচন ভবনের সামনে জলকামানও প্রস্তুত রাখা হয়।
যাদের জন্য ১৫ বছর লড়লাম, তারাই গায়ে হাত তুলল: ঘটনার পর সাংবাদিকদের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, গত ১৫ বছরে যা হয়নি, আজ তা-ই হলো। অলমোস্ট আমার গায়ে ধাক্কা দিয়ে আমাকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। বিএনপির যে নেতাকর্মীদের জন্য ১৫ বছর ধরে লড়াই করেছি, তারাই এখন আমাকে ধাক্কা দেয়। তো ঠিক আছে, ধাক্কার বদলে তো ধাক্কা আসবেই।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের আগে সীমানা নিয়ে যদি নিজ দলের মধ্যেই এমন পরিস্থিতি হয়, তাহলে কে জানে নির্বাচনে কী হবে।
রুমিন ফারহানা বলেন, অত্যন্ত দুঃখজনক ও লজ্জাজনক ঘটনা। আমি একজন আইনজীবী হিসেবে নিজের মামলার শুনানি নিজেই করতে এসেছিলাম। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের একজন মনোনয়নপ্রত্যাশী ২০-২৫ জন লোক নিয়ে এসে গু-ার মতো আচরণ করেছেন।
বিকেল পৌনে ৩টার দিকে এনসিপির কয়েকজন কর্মী ইসি ভবনের ২ নম্বর গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। তারা বলেন, ইসি ভবনের ভেতরে বিএনপি গু-ামি করছে। তবে নিরাপত্তাকর্মীরা তাদের ভেতরে ঢুকতে দেয়নি।
বিএনপির অন্যতম আওয়ামীবিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানা: গতকাল নির্বাচন কমিশন ভবনে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপির আওয়ামীবিষয়ক সম্পাদক রয়েছেন অনেকেই, যারা আওয়ামী লীগ থেকে বেশি আওয়ামী লীগ। তাদের মধ্যে অন্যতম রুমিন ফারহানা।
তিনি বলেন, হাসিনা বলত ২০টা হুন্ডা ১০টা গুন্ডা নির্বাচন ঠান্ডা। আজ রুমিন ফারহানা, যিনি হাসিনার কাছে ফ্ল্যাটের জন্য আবেদন করেছিলেন, হাসিনার পতনে আমার মনে হয় তিনিই সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছেন।
হাসনাত আরও বলেন, আওয়ামী লীগ থেকেও বেশি আওয়ামী লীগ পণ্য যাদের মনে হয়, তাদের মধ্যে রুমিন ফারহানা অন্যতম। উনি সবসময় বলে থাকেন, বিগত ১৫ বছর নাকি উনি অনেক ভালো ছিলেন। উনি অবশ্যই ভালো থাকবেন। কারণ, উনি যত ধরনের আওয়ামী সুবিধা রয়েছে, সব ধরনের সুবিধা নিয়েছেন।
এনসিপির এই নেতা বলেন, আপনারা দেখেছেন কীভাবে বিএনপির একজন নেত্রী বলছেন, আমরা চাইলে এখানে গুন্ডা নিয়ে আসতে পারতাম। অর্থাৎ গুন্ডার পৃষ্ঠপোষকতা উনারা দিয়ে আসছেন। আমরা দেখছি নির্বাচন কমিশনের বাইরে লাঠিসোটা নিয়ে মহড়া দিচ্ছে। নির্বাচন কমিশন, প্রধান নির্বাচন কমিশন অফিসের যদি এই অবস্থা হয়, সারা দেশে এই বিএনপির যারা রয়েছে, এই গুন্ডাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে, তারা কীভাবে ভোটকেন্দ্র দখল করবে সেটার টেস্ট ম্যাচ আজ হয়ে গেছে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে সিসিটিভি ফুটেজ রয়েছে। আমাদের নেতাকর্মীদের ওপরে হামলা করা হয়েছে। আবার আমরা যদি রুমিন ফারহানার কথাই ধরে নেই, নিজ দলের মধ্যেই এখনো পর্যন্ত কমান্ড নিশ্চিত করা হয় নাই, শৃঙ্খলা নাই। বিএনপির নেতাকর্মীরাই উনার কথা মতে উনাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। এটা খুবই শেইম।
উল্লেখ্য, গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২, ৩, ৫; কুমিল্লা-১, ২, ৬, ৯, ১০ ও ১১; নোয়াখালী-১, ২, ৪ ও ৫; চাঁদপুর-২ ও ৩; ফেনী-৩, লক্ষ্মীপুর-২ ও ৩ সংসদীয় আসনের শুনানি হয়। বুধবার পর্যন্ত এই শুনানি চলবে। এর আগে, গত ৩০ জুলাই সব সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে খসড়া প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। এতে ভোটার সংখ্যার সমতা আনতে গিয়ে গাজীপুর জেলায় একটি আসন বাড়িয়ে ছয় করা হয়। অন্যদিকে, বাগেরহাটের আসন চারটি থেকে কমিয়ে তিনটির প্রস্তাব করা হয়। ১০ আগস্টের মধ্যে ৮৩টি সংসদীয় এলাকার সীমানা নিয়ে ১ হাজার ৭৬০টি দাবি-আপত্তির আবেদন নির্বাচন কমিশনে জমা হয়। রোববার শুরু হওয়া এই শুনানি চলবে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত। এই চার দিন দাবি-আবেদন নিষ্পত্তি করে চূড়ান্ত সীমানা প্রকাশ করবে ইসি।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন