একটা সময় যে এলাকায় ছিল ছোট-বড় টিলার সমারোহ, ধর্মপ্রাণ ও পর্যটনপ্রেমীদের আনাগোনা ছিল নিত্য; সেই স্থানে এখন খন্ড খন্ড পুকুর। গত এক বছর ধরে পাথর ও বালুখেকোদের নিয়োগ করা শ্রমিকদের শাবল-কোদালের কোপে পূণ্যভূমি সিলেটের আলোচিত শাহ আরেফিন টিলা এখন বিলীন প্রায়।
জেলার ভোলাগঞ্জের সাদাপাথরের পাথর লুটের ঘটনায় উদ্ধার তৎপরতায় যখন ব্যস্ত প্রশাসন, তখন অনেকটা প্রকাশ্যেই হরিলুট চলছে কোম্পানীগঞ্জের শাহ আরেফিন টিলায়। অথচ এ নিয়ে পরিবেশকর্মীদের প্রতিবাদ ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের পরও নির্বীকার প্রশাসন।
এ নিয়ে দায়িত্বশীলদের বক্তব্য, তাদের প্রথম গুরুত্ব সিলেটের পর্যটন এলাকা আপাতত এসবে তাদের নজর নেই। এই সুযোগে নীরবে বিপুল উৎসাহে এগিয়ে চলেছে লুটেরাদের ধ্বংসযজ্ঞ। এ কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও বিএনপির নেতাকর্মীরা।
এদিকে সাদাপাথর লুটপাটের সময় যে রেলের রোপওয়ে বাঙ্কার এলাকা খেয়ে সাবাড় করে অস্তিত্বহীন করে ফেলা হয়, সেই বাঙ্কারের পাথর বা বালু উদ্ধারেরও কোনো তৎপরতা নেই। না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে বাক্য ব্যয় করছে, না প্রশাসন মাথা ঘামাচ্ছে। সাদাপাথরে পাথর কমবেশি ফিরতে শুরু করলেও বাঙ্কার এলাকা রয়ে গেছে আলোচনার বাইরে, শাহ আরেফিন টিলার মতন সবার চোখের আড়ালে।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চিকাডহর মৌজার বিশাল একটি টিলায় কয়েক শ বছর আগে আস্তানা গেড়েছিলেন শাহ আরেফিন (রহ.) নামের এক ওলি। সেই টিলা পরবর্তী সময়ে ‘শারফিন টিলা’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। এখানেই তার মাজার, আছে একটি মসজিদও। লাল মাটির টিলাঘেরা স্থানটিতে ঘুরতে আসতেন ধর্মপ্রাণ মানুষ ও পর্যটকেরা। কিন্তু সেই সব এখন অতীত। শাহ আরেফিন (রহ.)-এর স্মৃতিটুকু কোনো রকমে টিকে আছে। তার মাজারের চারদিকও খুঁড়ে ফেলা হয়েছে। আরেকটু হলেই লীন হবে তার কবর। পাশের দেয়ালের নিচ থেকে মাটি খোঁড়ায় দেয়ালের কিছু অংশ ভেঙেও পড়েছে। মাজারের পাশে থাকা মসজিদও এখন অস্তিত্বের সংকটে। মসজিদের দেয়াল ছুঁয়ে ফেলেছে পাথরখেকোরা।
চারদিক এরই মধ্যে তাদের পেটে চলে গেছে। আর একটু হলে সেই মসজিদও তারা গ্রাস করে নেবে। একটি ছোট্ট ঢিবির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে মসজিদটি। ৫০ ফুট গভীর গর্ত রয়েছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। অথচ এই গর্তগুলো ছিল উঁচু উঁচু টিলা। বড় বড় গর্ত করে পাথর তোলার ফলে সেটি এখন পুকুরে রূপ নিয়েছে। যেটুকু বাকি, তা গ্রাস করতে পারলেই পুরো শারফিনের মাজার সেখান থেকে বিলীন হয়ে যাবে। এরই মধ্যে তা হজম করার সব বন্দোবস্ত সম্পন্ন করেছে পাথর ও বালুখেকোরা।
সম্প্রতি শাহ আরেফিন টিলায় গেলে দেখা যায় সেখানকার করুণ চিত্র। একসময়ের টিলাঘেরা এলাকা এখন বিরানভূমি। সরকার পরিবর্তনের পর গত এক বছরে টিলা এলাকা ধ্বংস করা হয়েছে। এখন চারদিকে পুকুর। যেন রীতিমতো সমুদ্রে পরিণত করা হয়েছে পুরো শাহ আরেফিন টিলা এলাকা।
৩০ বছর আগে টিলার অংশসহ আশপাশের ১৩৭ দশমিক ৫০ একর জায়গাকে শারফিন টিলা পাথরকোয়ারি হিসেবে গেজেটভুক্ত করে সরকার। পরে মাজারের জন্য প্রায় ৮ একর জায়গা ওয়াক্ফ এস্টেটের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। টিলার নিচে রয়েছে বড় বড় পাথরখণ্ড। ২০ বছর ধরে পাথর উত্তোলনের কারণে কোয়ারি ও টিলার বিভিন্ন অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। অতীতে একাধিক সিন্ডিকেটের ধ্বংসের পর ২০২০ সালে শাহ আরেফিনসহ কয়েকটি কোয়ারিতে পাথর উত্তোলন বন্ধ করে সরকার।
তবে টিলাখোকোদের চোখ সরে আসেনি টিলার ওপর থেকে। তারা রাতের আঁধারেও চালায় ধ্বংসযজ্ঞ। অব্যাহত রাখে লুটপাট।
অভিযোগ আছে, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও প্রভাবশালীদের নিয়ে গঠিত ১৯ সদস্যের সংঘবদ্ধ চক্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় কোটি কোটি টাকার পাথর উত্তোলন করা হয়।
স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রথম দিকে মাঝেমধ্যে টিলা কাটার ঘটনা ঘটলেও চূড়ান্ত ছোবল বসানো হয় ২০০৮ সাল থেকে। তার পরের ৯ বছরের মাথায় এই টিলা পুরোটাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। প্রথম দফায় টিলার মাটি ধসে পাঁচ পাথরশ্রমিক নিহত হলে সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়। তার পরের দুই মাসে আরও দুই শ্রমিক নিহত হলে প্রশাসনের টনক নড়ে। এরপর টিলা সিলগালা করে রাখা হয়। শাহ আরেফিন টিলা ধ্বংসের অভিযোগে ২০০৯ সালের ১১ নভেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তরের ক্ষতি নির্ধারণী টিম তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে ১৩৭ দশমিক ৫০ একরের এই টিলাকে ‘মরা কঙ্কাল’ হিসেবে উল্লেখ করেছিল। পাশাপাশি পাথর উত্তোলন ও পরিবেশ ধ্বংসে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান বশির অ্যান্ড কোম্পানির কাছ থেকে ২৫১ কোটি ৫০ লাখ ৯০ হাজার টাকা আদায়ের প্রস্তাব করে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে সরকারের পতনের পর সেই মরা কঙ্কাল শারফিন টিলায় বিপুল উৎসাহে শুরু হয় পাথরখেকোদের তাণ্ডব। চারদিকে চলতে শুরু করে শাবলের মহাযজ্ঞ। নামানো হয় ড্রেজার মেশিন। কাজে নেমে পড়েন হাজার হাজার শ্রমিক। ব্যস্থতা বাড়ে ট্রাকসহ পরিবহন শ্রমিকদেরও। এরই মধ্যে পাথরখেকোদের আগ্রাসে বিলীন ও বন্ধ হয়ে গেছে মাজারে যাতায়াতের রাস্তা।
এই লুটপাটে জড়িয়ে রয়েছেন স্বয়ং শাহ আরেফিন (রহ.)-এর মাজারের খাদেমের উত্তরাধিকারী আব্দুল মান্নান ফকিরের বংশধরেরা। তাদের রয়েছে শক্তিশালী একটি গোষ্ঠী। তাদের আত্মীয়স্বজন সেখানে পাথর লুট করতে গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট। সেই সিন্ডিকেটের রয়েছে ১৯ সদস্যের শক্তিশালী বাহিনী।
এই বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছেন ১ নম্বর পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিয়াদ আলীর ছেলে আওয়ামী নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। যিনি জিন্নাহ নামে পরিচিত। তার নেতৃত্বে সেই দলে আছেন ইসলামপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুর রশিদ ও তার ভাই মনির মিয়া এবং যুবলীগের একই ওয়ার্ডের সভাপতি ফয়জুর রহমান, জালিয়ারপাড় প্রামের মৃত নঈম উল্লাহর ছেলে আব্দুর করিম, মৃত শুকুর আলীর ছেলে কালা মিয়া, মৃত আব্দুল খালিকের ছেলে বিএনপি নেতা বাবুল মিয়াও। তারা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলে না। তাদের লাঠিয়াল বাহিনী দিয়েই চলছে শাহ আরেফিন টিলার পাথর লুট।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় পুলিশ ও বিজিবিকে ম্যানেজের দায়িত্ব পালন করেন একই সিন্ডিকেটের মধ্যমণি যুবলীগ নেতা ফয়জুর রহমান ও বিএনপির নেতা বাবুল মিয়া। সাদাপাথরকাণ্ডে আগে প্রতিদিন কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উযায়ের আল মাহমুদ আদনানের ভাগের ২০ হাজার টাকা পৌঁছে দিতেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বড় ভাই আক্কাস আলী।
এ ছাড়া একটা সময় সেখানে দেখভাল করতে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা প্রতি গাড়ি থেকে ৫০০ টাকা করে নিতেন। আর অবৈধ বোমা মেশিন থেকে ৩ হাজার টাকা করে তোলা হতো। এখনো মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পরিবেশ অধিদপ্তরসহ অসংখ্য দপ্তরে টাকা দিয়ে যাচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, সিন্ডিকেটের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে এখনো টিলা কেটে পাথর লুট হচ্ছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর প্রতিদিন ২০ থেকে ৪০ ট্রাক পাথর সেখান থেকে বিক্রি করা হয়। যদিও বর্তমানে পাথর বিক্রি কিছুটা কমেছে। গত এক বছরেই প্রায় ৫ কোটি টাকার পাথর বিক্রি করা হয়েছে শারফিন টিলা থেকে।
শাহ আরেফিন ওয়াক্ফ এস্টেটের মোতাওয়াল্লি আনোয়ার হোসেন আনাই সম্প্রতি গণমাধ্যমকে জানান, তারা বাধা দিয়েও লুট ঠেকাতে পারছেন না। টিলার ওপর রয়েছে খেলার মাঠ, গোরস্থান, মক্তব ও মসজিদ। এরই মধ্যে অর্ধেক গোরস্থান ও মাঠ বিলীন হয়ে গেছে, মক্তবও বন্ধ। মাজার রক্ষা করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
এদিকে আরেকটি সূত্র জানায়, ভোলাগঞ্জ রেলওয়ের বাঙ্কার এলাকার তিনটি স্থানে পাথর উত্তোলন করে পুরো চেহারাই পাল্টে দেওয়া হয়। সেখানে এখন শুধু গর্ত। রোপওয়ের কোনো অস্তিত্বই নেই। রেলওয়ে সূত্র জানায়, পাথর পরিবহনে স্থল কিংবা জলযানের বিকল্প হিসেবে ১৯৬৪ সালে ভোলাগঞ্জ থেকে ছাতকে রজ্জুপথ স্থাপন করা হয়। বাঙ্কার এলাকায় রয়েছে ৩৫৯ একর জমি। ছিল অবকাঠামোসহ রেলের স্থাপনা, যন্ত্রপাতি।
সরকার পরিবর্তনের পর বারকি শ্রমিকদের একাধিক সিন্ডিকেট, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাকর্মী তা নিয়ন্ত্রণে নেন। তাদের বেপরোয়া লুটের কারণে সাদাপাথর থেকে এখন হারিয়ে গেছে পুরো রোপওয়ের অস্তিত্ব। বাঙ্কার এলাকা এখন শুধুই ধ্বংসস্তূপ।
শাহ আরেফিন টিলায় ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেট সদস্যদের অনেকেই আছেন চোখের আড়ালে। যোগাযোগ করা হলে এই চক্রের কর্তাদের মোবাইলও বন্ধ পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন সিলেটের সাধারণ সম্পাদক পরিবেশকর্মী কাশমির রেজা বলেন, সাদাপাথর নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বলে প্রশাসনসহ সবার চোখ সেদিকে। তদন্ত কমিটি হচ্ছে, পাথর ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টাও চলছে। অথচ একটি বিশাল পাহাড়ঘেরা অঞ্চল পাথরখেকোরা গিলে ফেলল, এ নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। উদ্ধারের কোনো উদ্যোগই নেই। দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তিরও কোনো তোড়জোড় নেই। এটি রহস্যজনক। পরিবেশ নিয়ে এরকম দ্বিমুখী নীতি গ্রহণযোগ্য নয়।
কোম্পানীগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রবিন মিয়া দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা শাহ আরেফিন টিলাকে ভুলে যাচ্ছি না বা সেটিকে আড়ালেও রাখছি না। এই মুহূর্তে আমাদের প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে পর্যটন এলাকা, একে আগে ফিরিয়ে আনা হবে তার আসল রূপে। তাই এখনই টিলা নিয়ে কাজ হচ্ছে না। দ্বিতীয় পর্যায়ে আমরা হাত দেব শারফিন টিলাসহ বাঙ্কার এলাকার দিকে। এসবের সঙ্গে জড়িত কেউ ছাড় পাবে না।’
সিলেটের জেলা প্রশাসক সরোয়ার আলম বলেন, ‘শাহ আরেফিন টিলা থেকে কালো ও হলুদ পাথর লুট হয়েছে। আমরা সেই পাথরের সন্ধানে আছি। আমরা খবর নিচ্ছি, কারও কাছে শাহ আরেফিন টিলার পাথর আছে কি না। অবশ্যই একশনে নামব, পাথর পেলে জব্দ করব। তবে আমরা পর্যটন কেন্দ্রকে অগ্রাধিকার দিয়ে পর্যটকদের পূর্বের সাদাপাথর ফিরিয়ে দিতে চাইছি।’

 
                             
                                    

 সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                    -20251031020255.webp) 
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       -20251025002118.webp) 
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন