টঙ্গী থেকে একটি কুরিয়ার সার্ভিসে ইতালিতে পাচারের সময় তোয়ালের মধ্যে বিশেষ কায়দায় লুকিয়ে রাখা সাড়ে ৬ কেজি ভয়ংকর মাদক কিটামিন জব্দ করেছে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। এই মাদক সংশ্লিষ্টতায় চাঁদপুর ও ফরিদপুর থেকে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
রাজধানীর সেগুনবাগিচায় গতকাল রোববার দুপুরে ডিএনসি সদও দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান মহাপরিচালক হাসান মারুফ। তিনি বলেন, আমাদের দেশে এই মাদকের ব্যবহার তেমন নেই। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে মাদকটি আসে। এরপর প্রসেস হয়ে বিদেশে চলে যায়। আন্তর্জাতিক মাদক চক্রের নতুন নতুন কৌশল প্রতিরোধে কুরিয়ার সার্ভিসের প্রতি নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে বলে তিনি জানান।
তিনি আরও বলেন, ডিএনসির গোয়েন্দা বিভাগ দীর্ঘদিন যাবৎ কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করে মাদক পাচারের বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি করে আসছে। এই তৎপরতার ফল হিসেবে বিভিন্ন সময় বেশ কিছু চালান জব্দ করা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে, ডিএনসির কাছে গোপন তথ্য ছিল যে একটি চক্র আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করে দেশের বাইরে মাদক পাচার করছেÑ এমন তথ্যে গোয়েন্দারা টঙ্গী ফেডেক্স কুরিয়ার সার্ভিসে অবস্থান নেন।
ফেডেক্সের সার্বিক সহযোগিতায় তারা ঢাকা থেকে ইতালিগামী একটি পার্সেল জব্দ করেন। গোয়েন্দা তথ্য, পার্সেলের সার্বিক অবস্থা ও অস্বাভাবিক ওজন দেখে সন্দেহ হলে পার্সেলটি পরীক্ষা করে একটি খাকি রঙের কার্টনের ভেতর পৃথক সাতটি সাদা তোয়ালে পাওয়া যায়। ঘটনাস্থলেই ডিএনসির রাসায়নিক পরীক্ষক তোয়ালের রাসায়নিক পরীক্ষা করে দ্রবীভূত অবস্থায় ৬.৪৪ কেজি ‘ক’ শ্রেণির ভয়াবহ মাদক কিটামিন পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে জব্দ হওয়া পার্সেলে প্রেরকের ঠিকানা, সিসিটিভি ফুটেজ ও অন্যান্য গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় যে, প্রেরক মো. মাসুদুর রহমান জিলানী (২৮) তার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে আত্মগোপন করেছেন। এসব তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকা গোয়েন্দা ইউনিট একটি অভিযান পরিচালনা করে চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর এলাকা থেকে প্রেরক জিলানীকে গ্রেপ্তার করে।
পরে আরও তথ্য পর্যালোচনা ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে জানা যায় যে কিটামিন চালানটি ফরিদপুর জেলার মো. আরিফুর রহমান খোকার (৪৩) যোগসাজশে বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা হচ্ছিল। খোকা এই আন্তর্জাতিক চক্রের অন্যতম হোতা।
এরপর তথ্য-প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ফরিদপুর জেলার সালথা থানার আটঘর বাজার এলাকায় আরও একটি অভিযান পরিচালনা করে খোকাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় খোকার কাছ থেকে দুটি অ্যানড্রয়েড মোবাইল ফোন এবং একটি বাটন মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে খোকা কুরিয়ারের মাধ্যমে কিটামিন পাচারের সাথে তার সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেন।
কিটামিন মূলত একটি ডিসোসিয়েটিভ অ্যানেস্থেটিক ওষুধ, যা অতীতে চিকিৎসাক্ষেত্রে অপারেশনের সময় অজ্ঞান করার জন্য ব্যবহৃত হতো। কিন্তু বর্তমানে এটি ব্যাপকভাবে মাদক হিসেবে অপব্যবহার করা হচ্ছে, বিশেষ করে পার্টি ড্রাগ হিসেবে। কিটামিন একটি অত্যন্ত ক্ষতিকর মাদক, যা স্বল্পমেয়াদে বিভ্রান্তি, হ্যালুসিনেশন ও শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি করে। দীর্ঘমেয়াদে এটি কিডনি ও মূত্রথলির গুরুতর ক্ষতি, মানসিক সমস্যা এবং আসক্তির দিকে ঠেলে দেয়। নিয়মিত সেবনে জীবনের জন্য ভয়াবহ ঝুকি তৈরি করে।
তোয়ালে বা মোটা কাপড় ব্যবহার করে মাদক পাচার একটি গোপন কৌশল। যেখানে তোয়ালের ভেতরে গঠন পরিবর্তন করে মাদক লুকানো হয়। কেমিক্যাল ইমপ্রেগনেশনে তোয়ালে মাদকের দ্রবণে ভিজিয়ে শুকানো হয়, ফলে মাদক ফাইবারে মিশে যায়। কাপড় বা তোয়ালেটি মাদক শোষণ করলে সেটি দেখতে স্বাভাবিক কাপড়ের মতোই মনে হয়, ফলে এটি সহজে শনাক্ত করা যায় না। পাচারকারীরা পরে বিশেষ কেমিক্যাল বা ল্যাব প্রসেস ব্যবহার করে ওই কাপড় থেকে পুনরায় মাদক উত্তোলন করে। এই পদ্ধতি কোকেন, হেরোইন ও কেটামিন পাচারে বেশি ব্যবহৃত হয়।
ডিএনসির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, আন্তর্জাতিক মাদক চক্রের নতুন নতুন কৌশল প্রতিরোধে কুরিয়ার সার্ভিস ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার সাথে সমন্বয় করে নিয়মিত নজরদারি ও অভিযান অব্যাহত থাকবে। গ্রেপ্তারকৃত আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে সংশ্লিষ্ট আরও একাধিক ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তদন্ত সাপেক্ষে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মাদক পাচারের রুট কি না জানতে চাইলে ডিজি মাদক বলেন, এটা বলা যাবে না। প্রতিটি দেশেই চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে মাদক আনা-নেওয়া হয়। ইয়াবার বিস্তার রোধে ডিএনসির পদক্ষেপ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা নিয়মিত অভিযান করছি। এ ক্ষেত্রে বাবা-মাকেও ভূমিকা রাখতে হবে। সন্তান কার সঙ্গে মেশে সেই বিষয়টা নজর রাখতে হবে।
বারিধারার মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সেলিম প্রধানের অবৈধ বার পরিচালনার ঘটনায় ডিএনসির গোয়েন্দা ব্যর্থতা আছে কি জানতে চাইলে জনবল সংকটের অজুহাত দিয়ে ডিজি বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে অপারেশন ও গোয়েন্দা কার্যক্রমে ১৬২২ জন কাজ করে সারা দেশে। এই স্বল্পসংখ্যক জনবল নিয়ে আমরা যেখানে তথ্য পাই, সেখানেই কাজ করি। বিগত ৬ মাসে আমাদের অভিযানের সংখ্যা বাড়ছে। বেশির ভাগ রেস্তোরাঁর আড়ালে সিসাবার পরিচালনা করা হয়।
এসব চক্রে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, এই চক্রের কোনো সদস্য ঢাকায় অবস্থান করে না। এসব মাদক তারা পাওয়ার পর প্রসেস করে ঢাকায় এসে বুকিং দিয়ে আবারও চলে যায়। এই চক্রের সঙ্গে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের সহযোগিতা রয়েছে। যদিও গ্রেপ্তারকৃতদের কেউই প্রবাসী ছিল না। তবে তাদের পরিচিত প্রবাসীদের সহযোগিতায় এই চক্র গড়ে ওঠে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন