সোমবার, ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


কাজী সাঈদ, কুয়াকাটা (পটুয়াখালী)

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৫, ০৫:৩২ এএম

অবৈধ জালে, বৈধ ক্ষতি

নিষিদ্ধ বেহুন্দি জালে থামছে না নিধনযজ্ঞ

কাজী সাঈদ, কুয়াকাটা (পটুয়াখালী)

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৫, ০৫:৩২ এএম

নিষিদ্ধ বেহুন্দি জালে থামছে না নিধনযজ্ঞ

নিষিদ্ধ বেহুন্দি জালে থামছে না নিধনযজ্ঞ

ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ছোট ছোট ডিঙি-ট্রলার ছুটছে সাগরের দিকে। কুয়াকাটা সৈকতের পশ্চিম দিকে লেম্বুরবনে দাঁড়ালে মনে হয় এসব ট্রলার বুঝি যাত্রা করছে নতুন অভিযানে। তবে এ অভিযানে নিধন হয় দেশের সম্ভাবনাময় সুনীল অর্থনীতির ভান্ডার। প্রত্যেকটি ট্রলারে আছে একাধিক নিষিদ্ধ বেহুন্দি জাল। সাগরের এমন কোনো মাছের পোনা নাই, যা বেহুন্দিজালে মারা যাচ্ছে না। বেহুন্দি জাল নামটা এখন সামুদ্রিক প্রাণীদের ভয়ের প্রতিধ্বনি। এ জালের চোখ এতটাই সূক্ষ্ম, সামান্য পোনামাছ থেকে শুরু করে ডিমওয়ালা মা মাছ পর্যন্ত রেহাই পায় না। জেলেদের একজন আমজাদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘এই জালে যা পাই সবই ধরি। সব ধরনের মাছ ধরা পড়ে। যখন মাছ ট্রলারে তুলি তখন জীবিত থাকে না।’ 

বাংলাদেশ মৎস্য সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী বেহুন্দি জাল নিষিদ্ধ। কারণ, এ জাল নির্দিষ্ট প্রজাতির মাছ নয়, বরং সামগ্রিক সামুদ্রিক পরিবেশের ওপর আঘাত হানে। স্থানীয় প্রশাসনের নজর এড়িয়ে কিংবা কখনো কখনো তাদের মদতেই চলছে নির্বিচার মাছ শিকার। এ জালে ধরা পড়ে মাছের পোনা, শুঁটকিজাত প্রজাতির মাছ, কাঁকড়া, কচ্ছপ, সামুদ্রিক সাপ ও পোকামাকড়। প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধসে পড়ছে চোখের সামনে। সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য বিষয়ে সচেতন শাহেদ আলী। তিনি বলেন, ‘বেহুন্দি জাল মানে প্রাকৃতিক পুনর্জন্মের পথ রুদ্ধ। আগামী প্রজন্মের জন্য মাছ থাকবে না, থাকবে শুধু সমুদ্রের জলরাশি।’ 

২০১১ সালেই বাংলাদেশ সরকার বেহুন্দি জাল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু বাস্তবে এর ব্যবহার ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। কুয়াকাটা, মহিপুর, আলীপুর, গঙ্গামতী, কাউয়ারচর, আশাখালী, আন্ধারমানিক মোহনা, রামনাবাদ মোহনা, সোনাতলা নদী, খাপড়াভাঙ্গা নদীসহ গোটা উপকূলজুড়ে এ জালের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। 

নিষিদ্ধ এ জাল কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগেই একজন মাঝি হেসে বলেন, ‘নইলে পেট চলবে কেমনে ভাই? বেহুন্দি জাল না হলে চিংড়ি ধরা যায় না। পেট তো চালাইতে হয়।’

পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার সোনাতলা নদীর পাড়ে নিজামপুর কোস্টগার্ড স্টেশন। এ নদীতেই অন্তত শখানেক বেহুন্দি জাল পাতা হয়। আন্ধারমানিক মোহনা থেকে সোনাতলা নদীর শেষ প্রাপ্ত পর্যন্ত সুবিধাজনক জায়গায় বেহুন্দি পাতা দেখা যায়। নিজামপুর কোস্টগার্ড স্টেশনের পশ্চিম পাশে নেটজাল টেনে বাগদা চিংড়ির পোনা ধরছেন বয়োবৃদ্ধ এক জেলে দম্পতি। তাদের সঙ্গে কথা হয়। 

ফুলভানু (ছদ্মনাম) বলেন, ‘এ নদীতে ম্যালা বেন্দি পাতে। -চাচি কোস্টগার্ড কিছু বলে না? 

-না বাবা, কোস্টগার্ড অভিযানের নামার আগে জেলেদের সতর্ক করে। তারা মাঝে মাঝে দূর থ্যাইকা জাল আইন্যা পুইর‌্যা ফালায়।’

এ কথার ফাঁকে এক যুবক আসেন সেখানে। সে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কোস্টগার্ড অফিসের পাশের গরিব জেলেদের একটু সুযোগ দেওয়া হয়। তবে তারা কোনো টাকাপয়সা নেয় না। মাঝেমধ্যে যদি অফিসের কোনো কাজ থাকে তাহলে স্থানীয় জেলেদের ডেকে কাজ করান, এতটুকুই।’ 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড দক্ষিণ জোনের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট (বিএন) মো. আবুল কাশেম সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে কৌশলে বলেন, ‘কোস্টগার্ড শুধু বেহুন্দি জালই নয়, ব্যবহার নিষিদ্ধ সব ধরনের জালের ব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে এবং নিয়মিতভাবে অভিযান পরিচালনা করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় কোস্টগার্ডের স্টেশন নিজামপুর কর্তৃক সোনাতলা নদীসহ দায়িত্বধীন তৎসংলগ্ন এলাকায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে অবৈধ ঘোষিত জালসমূহ ব্যবহার বন্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। ভবিষ্যতেও এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে।’ 

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চলতি বছরে কোস্ট গার্ড দক্ষিণ জোন কর্তৃক প্রায় ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা মূল্যের ২ হাজার ৭০০ পিস বেহুন্দি জাল স্থানীয় মৎস্য প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বিনষ্ট করা হয়েছে।’

বেহুন্দি জালের মারাত্মক প্রভাব পড়ছে জেলেদের জীবন জীবিকায়ও। আজ যে মাছ ধরা যাচ্ছে, কাল তা থাকবে না। মাছের সংখ্যা হ্রাস পেলে জেলেরা পড়বে আর্থিক অনিশ্চয়তায়। সাগরে মাছের প্রজনন বাধাপ্রাপ্ত হয়ে উৎপাদন কমে গেছে। গত এক দশক আগেও জেলেরা অনেক প্রজাতির বড় আকারের যেসব মাছ পেত, কিন্তু এখন অনেক প্রজাতির মাছ পাচ্ছে না। বছরের বেশির ভাগ সময় না পেয়ে দেনাগ্রস্ত হয়ে পরেড়ছে অনেক পরিবার। অনেকেই এরই মধ্যে বিকল্প কর্মসংস্থানের খোঁজে শহরমুখী হচ্ছেন। মহিপুর থানার লতাচাপলী ইউনিয়নের মাইটভাঙ্গা গ্রামের তৈয়ব আলী মাঝি। তিনি দীর্ঘ সময় সমুদ্রে মাছ ধরা ট্রলারের প্রভাবশালী মাঝি ছিলেন। গত চার বছর ধরে তিঁনি ঢাকার কেরানীগঞ্জে পাথর, বালুর বলগেট স্টিমারে কাজ করছেন। কথা হয় তার সঙ্গে, তিনি বলেন, ‘বাবা, আগের চেয়ে ভালো আছি। সংসারে অভাব নাই, কোনো দেনা নাই। মাস শেষ বেতন পাই, ভালো চলছে।’ 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনের কঠোর প্রয়োগ ও জেলেদের সচেতনতা বৃদ্ধিই পারে অনিয়ম ঠেকাতে। পাশাপাশি বিকল্প বৈধ জাল ব্যবহারে উৎসাহ এবং ক্ষতিপূরণের বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। আলীপুরের জেলে নেতা রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ‘শুধু জাল জব্দ করলেই হবে না, মনও বদলাতে হবে।’       

বঙ্গোপসাগর, সাগরের মোহনায়, নদী ও খালে বিভিন্ন নামের বেহুন্দি জাল দিয়ে মৎস্য সম্পদ ধ্বংস করা হচ্ছে। এর মধ্যে ইন্ডিয়ান নেটের তৈরি বেহুন্দি জাল দিয়ে বাগদা চিংড়ির পোনা বা রেণু ধরা হয়। ডিঙি ট্রলারে জিরো ফাঁসের বেহুন্দি জাল দিয়ে ভুলা চিংড়ি ধরে জেলেরা। মাঝারি আকারের বেহুন্দি জাল দ্বারা চাকা, বাগদা, গলদা, টাইগার চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরা হয়। কাঠের তৈরি ট্রলার থেকে রূপান্তরিত ট্রলিং ট্রলারে হাইড্রোলিক বা গিয়ারচালিত উইঞ্চ সংযোজন করে বড় আকারের বেহুন্দি জাল সমুদ্রে টেনে ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শিকার করা হয়। অর্থাৎ নিষিদ্ধ বেহুন্দি জাল বিভিন্ন নামে আলাদা আলাদা মাছ ধরার জন্য ব্যবহার করা হয়। যে নামেই হোক বেহুন্দি জাল সাগরের ভবিষ্যৎ শেষ করে দিচ্ছে।

লম্বা জালের মাঝি ইউনুচ মিয়া বলেন, ‘সকল প্রকার বেহুন্দি জাল সরকার বন্ধ করলে আর অবরোধ সঠিকভাবে পালন করলে সাগরে মাছ আর পানি সমান হবে। আমাদের দুশ্চিন্তা করতে হবে না।’

ওয়ার্ল্ডফিশের গবেষণা সহকারী বখতিয়ার রহমান বলেন, ‘নিষিদ্ধ বেহুন্দিজাল সমুদ্রের বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা, ডিম ও খাবার নষ্ট করছে। ৪০ মিলিটারের নিচের সব জাল অভিযান চালিয়ে ধ্বংস করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকি দিয়ে হলেও করতে হবে। ’

কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, ‘জনবলসংকটের কারণে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে পারছি না। তবে জেলেরা এখন অনেকটা সচেতন। এ জালের ব্যবহার আগের চেয়ে কমছে। তারপরও আমরা অবৈধ বেহুন্দি জালের ব্যবহার বন্ধে সতর্ক আছি।’
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!