আওয়ামী লীগ নেতা স্বপন মিয়া। স্থানীয়দের কাছে তিনি পরিচিত স্বপন হাজি নামে। মাত্র ১৬ বছর আগেও রাজমিস্ত্রি ছিলেন তিনি। কখনো রিকশা চালাতেন, কখনোবা হোটেলকর্মী। কিন্তু আওয়ামী লীগের সময়ে সাক্ষাৎ পান আলাদিনের চেরাগের। সেই চেরাগের বদৌলতে আজ তিনি শত শত কোটি টাকার মালিক। চড়েন বিলাসবহুল গাড়িতে। অধিকাংশ সময়ই থাকেন ঢাকায়। নিজের পোষা বাহিনী দিয়ে পরিচালনা করেন সুনামগঞ্জের রাজত্ব। ছাতকে আছে তার অন্তত ৭টি বহুতল বিশিষ্ট বাসাবাড়ি। গ্রামে আছে নামে-বেনামে জায়গা-সম্পত্তি। ২০২১ সালে নরসিংপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক না পেয়ে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী হন। যদিও পরাজিত হন, তবে স্থানীয় রাজনীতিতে তার প্রভাব রয়েছে আগের মতোই।
আওয়ামী লীগ আমলে গভীর সম্পর্ক ছিল স্থানীয় এমপি মুহিবুর রহমান মানিকের সঙ্গে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ জাতীয় অনেক নেতার সঙ্গেও তার সখ্য গড়ে ওঠে। মুহিবুর রহমান মানিকের ঘনিষ্ঠ সহচর হওয়ার পর থেকে শুরু হয় টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, বালু-পাথরের ব্যবসা, সীমান্তে চোরাচালানসহ নানা অবৈধ কর্মকা-। বর্তমানে স্বপনের নিয়ন্ত্রণে পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপদ, শিল্প কারখানায় কোটি কোটি টাকার প্রকল্প রয়েছে। বালুপাথর সিন্ডিকেটে তার বেশ প্রভাব। ছাতক ও দোয়ারাবাজারের সীমান্তবর্তী এলাকায় ভারতীয় বালুপাথরের চোরাই ব্যবসায় স্বপনের নাম জড়িত। অভিযোগ রয়েছে, নদীপথে তার মালিকানাধীন একাধিক জাহাজ ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত চলছে এসব পণ্য পরিবহন। সুরমা নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলনেও তার নেতৃত্বে সক্রিয় একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে।
দিনমজুর স্বপন মিয়া ঠিকাদারিতে নাম লেখানোর পর দ্রুত দিন পাল্টাতে শুরু করে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ছাড়াও তার রাজত্ব বিস্তৃত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ছাতক সিমেন্ট কারখানা, রেলওয়েসহ সর্বত্র। প্রায় সব টেন্ডার যেতে হয় তার হাত ছুঁয়ে। তিনি টেন্ডার নিয়ে সেই টেন্ডার বিক্রিও করে দেন কখনো কখনো। আবার প্রকল্প কাজ করান নিজে। তার কোম্পানির নাম ‘বিসমিল্লাহ সোনালী চেলা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড’। অফিস ঠিকানাÑ রহমতবাগ, ছাতক। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির যে অভিযোগ, তা মূলত তার মাধ্যমেই সংঘঠিত। তার বিসমিল্লাহ সোনালী চেলা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের নামে কোটি কোটি টাকার কাজ পাইয়ে দিয়ে নিজেদের পকেট ভারী করছেন পাউবোর কর্তারা।
স্থানীয় একজন ঠিকাদার দাবি করেন, সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী শমসের আলী টাকার বিনিময়ে এসব কাজ পাইয়ে দেন। আওয়ামী লীগ শাসনামলে এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সুনামগঞ্জ জেলায় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। বর্তমানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলেও দোয়ারাবাজার উপজেলায় নদী ভাঙন রক্ষা প্রকল্পে একই প্রতিষ্ঠানের নামে অন্তত ৪টি কাজ চলমান। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গুণগতমান উপেক্ষা করে শুধু অবৈধ লেনদেন ও স্বপন মিয়ার প্রভাব খাঁটিয়ে এসব কাজ আদায় করা হচ্ছে।
হঠাৎ টাকার কুমির বনে যাওয়ার পর স্বপন মিয়া জমি ও বাসাবাড়ি কেনার দিকে মনোযোগ দেন। টাকা ব্যাংকে জমিয়ে না রেখে তা জমিতে বিনিয়োগ করেন। স্থানীয় সূত্র জানায়, বর্তমানে পৌর শহরের মন্ডলীভোগে ২টি, রহমতবাগে ২টি, ছুরাবনগর ও লেভারপাড়ায় ১টি বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে স্বপনের। এ ছাড়া কোর্ট রোড এলাকায় ৯০ শতক জমি, ৫টি বালগেড এবং নগদ টাকাসহ কয়েক শতকোটি টাকার মালিক তিনি। শহরের আরও অন্তত ৬টি বহুতল ভবন, মার্কেট এবং নামে-বেনামে জমির মালিকানা তার নামে। বিলাসবহুল জিপগাড়িতে তাকে চলাফেরা করতে দেখা যায় নিয়মিত।
চলতি বছরের ২ জুলাই বিসমিল্লাহ সোনালি চেলা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের মাধ্যমে ছাতক সিমেন্ট কারখানার প্রায় ৭১ কোটি টাকার পুরাতন মালামালের টেন্ডার পান স্বপন হাজি। এর আগেও দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠানের এমডি আব্দুর রহমান বাদশার সঙ্গে গোপন সমঝোতায় দেড়শ কোটি টাকার প্রকল্প থেকে ৭২ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।
ছাতক সিমেন্ট কারখানা সূত্র জানায়, সম্প্রতি কারখানার পুরাতন অন্তত দেড়শ কোটি টাকার যন্ত্রপাতির টেন্ডার ভাগিয়ে নেন ৭১ কোটি টাকায়। কারখানার এমডি আব্দুর রহমান বাদশার সহায়তায় বিসমিল্লাহ সোনালি চেলা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের নামে এই টেন্ডার অনেকটা গায়ের জোরে নিয়ে নেন বলে অভিযোগ। কয়েক ডজন টেন্ডার বিক্রি হলেও শেষ পর্যন্ত জমা হয় মাত্র ৩টি। সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে তাকে টেন্ডার দেয় কারখানা কর্তৃপক্ষ। যদিও এটি এখন তিনি সাব কন্ট্রাক্টে বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছেন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাছে। সর্বশেষ ৮০ কোটি টাকা দর উঠলেও বিক্রি করেননি।
সূত্র জানায়, একাধিক মামলার আসামি স্বপন হাজি ৭১ কোটি টাকায় ট্রেন্ডার নিয়ে এখন পর্যন্ত কারখানা কর্তৃপক্ষকে জমা দিয়েছেন মাত্র ৭ কোটি ১০ লাখ টাকা। বাকি টাকা সাব কন্ট্রাক্টে বিক্রি করে পরিশোধের বন্দোবস্ত করার চেষ্টা করলেও বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে জানাজানি হলে বেকায়দায় পড়েছেন। এরই মধ্যে টেন্ডারের সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। চলতি সপ্তাহের মধ্যে উপরের হস্তক্ষেপে অর্থ বাকি থাকার অজুহাতে টেন্ডার বাতিল হয়ে যেতে পারে বলে গুঞ্জন শোনা গেলেও গতকাল সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর সময় আরও ৪৫ দিন বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে স্বপন মিয়া বলেন, ছাতক সিমেন্ট কারখানার একটি টেন্ডার আনার পর থেকে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু হয়েছে। এই টেন্ডার আমি একাও আনিনি। আমার সঙ্গে আছেন জামায়াত ও বিএনপির ব্যবসায়ীরা। সবাই মিলে কাজ এনেছি। কিন্তু যারা নিতে পারেনি তারা এখন আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমাকে ভিলেন বানিয়ে দিচ্ছে। অথচ আমি কষ্ট করে, পরিশ্রম করে সম্পদের মালিক হয়েছি। রাতারাতি টাকার মালিক হইনি। ৩০০ টাকা বেতনে কাজ করে আজ সফল। এতেই তাদের ঈর্ষা।
তিনি আরও বলেন, আমার কোনো অবৈধ আয় নেই। আমার বলগেট আছে, বালু পাথরের ব্যবসা আছে। মাসে আল্লাহর রহমতে ভালো আয় করি। আমাকে আল্লাহ অনেক দিয়েছেন, আমি কেন অবৈধ পথে যাব? তিনি দাবি করেন, তার নিজের লাইসেন্স আছে। ‘লাইসেন্স নাই’ এটি সঠিক নয়। ছাতকে ৭টি বাড়ি সম্পর্কে বলেন, এখানে আমার ৩টি বাড়ি আছে। আয় করে এগুলো কিনেছি। অন্যায় করিনি।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন